রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি থেকে ঘুরে এসেছি বেশিদিন হয় নি, বলতে গেলে সেই ট্যুরের রেশ কাটেনি।
মুপ্পোছড়া, ধুপপানি ঝর্ণার মুগ্ধতা কাটানো কি এত সহজ ?? সেই ট্যুরই আবার নতুন করে আরেকটা ট্যুরে যাবার প্রেরণা যোগালো। কিন্তু কোথায় যাবো তা ঠিক করে উঠতে পারলাম না। অনেকে বললো মিরসরাইয়ের ঝর্ণা গুলায় যেতে। কিন্তু মনঃপুত হল না কারণ আপেক্ষাকৃত একটু কঠিন ট্রেইলে যেতে চাই আমি। তিনাপ সাইতারকে বেছে নিলাম তাই। প্ল্যান করলাম রোয়াংছড়ি দিয়ে তিনাপ সাইতার দেখে আত্তাপাড়া দিয়ে বের হবো। প্ল্যান প্রস্তুত কিন্তু আমি যাদের সাথে ট্যুর দেই তারা একজনও যেতে পারবে না এবার। এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল ট্যুরটা বুঝি ভেস্তে গেল, তাও দমে যাইনি। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম। সেখান থেকে দুইজন ম্যানেজ হল। একজন আমার স্কুলফ্রেন্ড আরাফাত, আরেকজন ভার্সিটির জুনিয়র সাগর। কিন্তু তিনজন মিলে তো আর এই ট্যুর দেয়া সম্ভব না। তাই শেষ ভরসা হিসেবে “#ট্রাভেলার্সঅববাংলাদেশ” গ্রুপে পোস্ট দিলাম। আরো কিছু পোলাপান জোগাড় হয়ে গেল এর মধ্যে ভার্সিটির আরো চারজন জুনিয়র ছিলো। পূজার ছুটিতে যাবো তাই টিকেট পাই কি না পাই সেই আশংকা ছিলো। তাই তাড়াতাড়ি করে টিকেট কাটতে গেলাম। কাউন্টারে টিকেট কাটার আগে ডিপার্টমেন্টের দুই জুনিয়র বললো যাবে। ১২ই অক্টোবর রাতের টিকেট কেটে ফেললাম। এবার শুধু অপেক্ষার পালা।
অতঃপর আসলো সেই কাঙ্ক্ষিতক্ষণ। যেহেতু এক্সট্রিম টাইপের ট্রেকিং করতে হবে, তাই সবাইকে সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে বললাম। ট্রেকিংয়ের জন্য সাথে অ্যাঙ্কলেট, নি-ক্যাপ এবং হালকা খাবার হিসেবে ম্যাঙ্গোবার, বাদাম ইত্যাদি আর স্যালাইন, গ্লুকোজ আর প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ নিয়ে নিলাম সাথে। এত অল্প করে নিলাম সবকিছু তারপরেও ব্যাগের ওজন ১০ কেজির বেশি হয়ে গেল। ইউনিকের বাসে করে বেশ সকালেই (৬টার দিকে) পৌঁছে গেলাম বান্দরবান শহরে।
আমাদের টিমের মোট মেম্বার ছিলো ১২ জন। বান্দরবানের একটা হোটেলে হালকা নাস্তা করে চান্দের গাড়ি ঠিক করলাম রোয়াংছড়ি পর্যন্ত। পাহাড়ি উচু-নিচু রাস্তা দিয়ে প্রায় ৫০ মিনিট পরে এসে পৌছালাম রোয়াংছড়ি থানার সামনে। রোয়াংছড়ি থানায় এন্ট্রি করে গাইডের সাথে বাজারে আসলাম এবং বেশ কিছু সময় চলে গেলো আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে যেয়ে। এরই মধ্যে আবার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল। আমাদের টিমের ১২ জনের ৮ জনেরই ট্রেকিং করার ধারণা ছিলো না। সকাল যখন প্রায় ৯ টা তখন আমরা রওয়ানা দেই। ট্রেকিং করার উপযোগী ওয়েদার ছিলো, হাঁটতে ভালোই লাগছিলো। ঝিরিপথ দিয়ে হাটছিলাম। মাঝে এক জায়গায় শরীরটা ভিজিয়ে নিলাম। কিন্তু ঝিরিপথটা শেষ হতে বেশিক্ষন লাগলো না। ৩০ মিনিটের মত পথটা। এরপর শুরু আমাদের ট্যুরের মেইন ট্রেকিং। ব্যাগ কাধে নিয়ে প্রথমে সবাই বেশ ভালো গতিতেই আগাচ্ছিলো। কিন্তু একটা জায়গায় এসে হোসেন নামের এক ছোট ভাইয়ের পা ক্র্যাম্প করলো। বলে রাখা ভালো যে হোসেন আর হাসান দুইজন জমজ ভাই। ওর ব্যাগ নিলাম আমি, মামুন ভাই আর মনির ভাইয়ের কাধে ধরে ও আসতে লাগলো। রাস্তা পিচ্ছিলা থাকায় আছাড় খাবার সম্ভাবনা ছিলো বেশ। উচু জায়গা থেকে নিচে নামার সময় ওর বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। সামনের সবাই বেশ এগিয়ে গিয়েছিলো। একটা জায়গায় এসে সবাই রেস্ট নিলাম। পাহাড়ের উপর থেকে আশেপাশের প্রকৃতি অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো। ততক্ষনে সূর্য ঠিক মাথার উপর উঠে গিয়ে আগুন ঝরাচ্ছে। আবার হাটা শুরু করলাম সবাই। গাইড আমাদের রাতের খাবারের জন্যে বাজার থেকে দুইটা মুরগি কিনে নিয়েছিলো। মুরগি দুইটাকে দেখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী প্রাণী বলে মনে হচ্ছিলো। ইশ! কেউ যদি আমাকে এমনভাবে নিয়ে যেত পুরোটা পথ। ওদের আরাম দেখে বেশি হিংসে হচ্ছিলো। হাঁটছি আর সাথে থাকা বোতল থেকে স্যালাইন মিশ্রিত পানি থেকে দুই-এক চুমুক দিচ্ছিলাম। প্রায় দুপুর ১টার দিকে কেপ্লংপাড়া এসে পৌঁছুলাম। পাড়ার এক দোকানে বসে কলা, ডিম, পানি খেলাম। বেশ কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম।
দুপুরের দিকে রোদ তখন অসহনীয় মাত্রায় চলে গেছে। কিন্তু হাটা ছাড়া কোন উপায় নাই। ইচ্ছা ছিলো রনিপাড়ায় তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারলে এর পাশেই এক ঘণ্টা ট্রেক করে যেতে হয় “তিদংখট” নামে একটা ঝর্না আছে, সেটায় যাবো। তাই সবাইকে তাড়া দিতে থাকলাম। কিন্তু পা তো সে কথা মানতেই চাইছে না। একটা পাড়া থেকে পানি ভরে নিলাম বোতলে করে। মনের জোরে পথ চলতে থাকলাম। অনেকক্ষণ হাটার পর মাত্র ৩০ সেকেন্ডের জন্যে বসেছি এই সময় ফাহাদ ভাই সামনে থেকে চিৎকার করে বলতেছে “সামনে ঝর্ণা দেখা যায়”। কথাটা শুনা মাত্রই উঠে দৌড় লাগালাম। কিন্তু কিছুদূর যেতেই বুঝলাম এযে শুভঙ্করের ফাকি। একেকটা পাহাড় উঠি আর নামি। এর যেন আর শেষ নাই। যাইহোক, এতক্ষণে আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি যে গাইড আমাদেরকে নেক্সট ডেস্টিনেশনের পৌঁছাতে যে টাইমের কথা বলবে তাকে অবশ্যই ২ অথবা ৩ দিয়ে গুন করে নিতে হবে। যেমনঃ সে যদি বলে অমুক জায়গায় পৌঁছাতে ২০ মিনিট লাগবে, তারমানে বুঝতে হবে সেখানে আমাদের পৌঁছাতে মিনিমাম ৪০ মিনিট লাগবেই। এক সময় আমরা একটা ছাউনি দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায় এসে উপস্থিত হলাম। জায়গাটা থেকে সিপ্পি, টেবিল পাহার এবং আমাদের গন্তব্য রনিপাড়া দেখা যায়। যখন রনিপাড়াকে চক্ষুসীমার মধ্যে দেখেছিলাম একটা আলাদা রকমের শান্তি অনুভব করেছিলাম। সাথে আনা শুকনো খাবার খেলাম, পানি শেষ করে ফেললাম- তৃষ্ণা পেয়েছিলো প্রচুর। একে একে করে সবাই এসে পড়লো যারা পিছনে পড়েছিলো। কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়ার পর পাহাড়ের গা ঘেঁষে করা রাস্তা ধরে নামতে হল। খুবই বিপদজনক ছিলো রাস্তাটা, ধরার মত তেমন কিছুই ছিলো না আর পাশে ছিলো গভীর খাদ। এই জায়গাটা থেকে ছোট-বড় দুইটা টেবিল পাহাড়েরই ভিউ সবচেয়ে ভালো পাওয়া যায়। আল্লাহর অশেষ রহমতে সবাই নিরাপদেই নামতে পারলো।
রনিপাড়া আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছাতে প্রায় এক ঘণ্টার মত লেগে গেল। গাইডকে নিয়ে আর্মি ক্যাম্পে গেলাম। সেখানে আর্মির এক সোলজার এর সাথে কথা হল তার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে - আমরা যে রুট দিয়ে ইন করেছি সেই রুট দিয়েই নাকি ব্যাক করতে হবে। এই কথা শোনার পর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। ঢাকা থেকেই প্ল্যান করে এসেছিলাম ট্রেকিং করে রোয়াংছড়ি দিয়ে ইন করবো আর রিলাক্সলি আত্তাপাড়া হয়ে রুমা দিয়ে ব্যাক করবো। কিন্তু তার কথা শোনার পর এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো সব। সম্বিত ফিরে পেলাম ঐখানকার আর্মি অফিসারের কথায়। সে আমাদেরকে জানালো আমরা আমাদের প্ল্যান মতই যেতে পারবো। সেখানে আমরা সবাই আমাদের নাম এন্ট্রি করলাম। তারপর আর্মি অফিসার আমাদের কিছু উপদেশমূলক বানী দিলেন, কথাগুলো মানার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম আমরা। তারপর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রনিপাড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। কিছুক্ষণ পর পাড়ায় ঢুকলাম। দেখলাম আমাদের মত একদল ট্রাভেলার আদিবাসীদের সাথে ফুটবল খেলছে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে কারবারীর বাড়িতে। সেখানে ব্যাগ রেখে সারাদিন পর একটু রিল্যাক্সলি বসলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে এবং আকাশে সুন্দর একটা চাঁদও উঠেছে। বাড়ির কিছু সামনেই একটা পাইপ থেকে চৌবাচ্চায় পানি এসে পড়তেছে। আর সেই পানিতে মানুষজন গোসল করছিলো। সবার গোসল করা শেষ হলে আমরাও গেলাম গোসল করতে। মাথার উপর ততক্ষণে চাঁদটা জ্বলজ্বল করতেছিলো। পানিটা ভীষণ ঠাণ্ডা ছিলো। পানিটা গায়ে ঢালার সাথে সাথেই সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। মনেই হল না আমার লাইফের সবচেয়ে কঠিন ট্রেকিংটা করে এসেছি। পানি ঢালতেই থাকলাম, গোসল যেন আর শেষ হয় না। কিন্তু আর মানুষের গোসল করা বাকি তাই বাধ্য হয়ে পানি ঢালা অফ করলাম। তারপর বাড়িতে গিয়ে একটু রেস্ট নিলাম। সাথে আনা ম্যাগি নুডুলস রান্না করা খেলাম। কিছুক্ষণ পর রাতের খাবার খাওয়ার জন্যে সামনের আরেক বাড়িতে গেলাম। সেখানে মুরগীর মাংস আর জুম চালের ভাত খেলাম। ভাত খাবার পর একটু হাঁটতে বের হলাম গাইডের সাথে যে গাইড পরেরদিন আমাদেরকে তিনাপ সাইতার নিয়ে যাবে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় পাড়ার মধ্যে হাটতে বেশ ভালো লাগতেছিলো। একটা দোকানে ঢুকে র-চা খেলাম। তারপর আরেকটু ঘুরাঘুরি করে ঘরে এসে ১০ টার একটু পর সোজা ঘুমোতে গেলাম।
অনেকক্ষণ ঘুমালাম কিন্তু হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মনে হল ৪/৫টা বাজে কিন্তু মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখি মাত্র ১২.৪৫ বাজে। আবারো ঘুম দেয়ার চেষ্টা করলাম, হল না। রাত ৪ টার দিকে আবার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বাইরে থেকে মাইকে কিছু বাজানো হচ্ছে। এই রাতের বেলা এমনভাবে মিউজিক বাজানোর কাহিনীটা বুঝলাম না। তবে বেশ শ্রুতিমধুর লেগেছিলো যদিও গানের ভাষা আগামাথা কিছুই বুঝি নাই। ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হলাম। বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে পুরা থ হয়ে গেলাম। এই রকম আকাশ ভর্তি তারা আমার জীবনে আমি দেখি নাই। পুরাটা আকাশ তারার আলোয় উদ্ভাসিত। রেমাক্রির আকাশে তারা দেখেছিলাম কিন্তু এর তুলনায় কিছুই না। আকাশের আনাচে কানাচে ভর্তি তারা। এমন আকাশ ভরা তারা দেখতে কপাল লাগেরে ভাই। ক্লান্ত না থাকলে আর তিনাপ সাইতার দেখার জন্যে এনার্জির দরকার না হলে সারা রাতে আকাশের দিকে তাকাইয়াই কাটাইয়া দিতাম নিশ্চিত। অগ্যতা বাধ্য হয়ে তারা দেখা শেষ করে আবার ঘুমাতে চলে গেলাম।
পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গেলাম প্রায় ৬ টার দিকে। সবাইকে ডেকে উঠালাম। ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা করলাম ডিম ভাজা, ডাল আর জুম চালের ভাত দিয়ে। খেয়েদেয়ে সবাই রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম তিনাপের উদ্দেশ্যে। গাইড ছিলো দুজন। গাইড আমাদেরকে জঙ্গল থেকে বাঁশ কেটে দিলো। এই বাঁশ হাতে নিয়ে হাটতে থাকলাম। বাঁশের উপকারিতা ট্রেকাররা বেশ ভালোভাবেই জানে, এই বাঁশ না থাকলে যে কত বাঁশ খাইতে হত কে জানে। খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হচ্ছে, দৃষ্টি যতদূর যায় ততদুর খালি খাড়া পাহাড়। সামনের দিকে তাকালেই ভয় লাগে যে এই ব্যাগ কাঁধে নিয়া এত উপরে উঠতে হবে। তাই আর উপরে না তাকিয়ে ট্রেইলের দিকে তাকিয়ে পথ উঠতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে সবার পিছন সামনের দিকে এসে পড়লাম। বন জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হচ্ছে, পাশে খাঁদ ছিলো। কিন্তু ভয়ডর ছাড়াই একের পর এক জায়গা পার হয়ে গেলাম। একটা জায়গায় বেশ উঁচু থেকে নিচুতে নামতে হয়, ধরার মত তেমন কিছু ছিলো, পাশে আবার বিরাট একটা খাঁদ। বসে বসে সাবধানতার সাথে নামলাম। আরো কিছুক্ষণ হাটার পর দেবাছরা পাড়ায় এসে পড়লাম। বাকি সবাই অনেক পিছনে পড়ে গেছে। ঐ পাড়ায় আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন দেখলাম তখন আমরা দেবাছড়া ঝিড়িতে যেয়ে রিল্যাক্স করতে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর পিছনে পড়ে থাকা সবাই এসে পড়লো। আবার যাত্রা শুরু করতে যাবো তখন দেখি পায়ে একটা জোক ধরেছে। জোক ছাড়ানো হল, রক্ত বেশি খাইতে পারে নাই। ঝিরিপথ থেকে উঠে আবার পাহাড় বেয়ে উঠা শুরু হল। একটা জায়গায় এসে অনেক নিচে নামতে হল, বারবার স্যন্ডেল গ্রিপ হারিয়ে ফেলছিলো। পড়ে গেলে খুব খারাপ কিছুই হতে পারত। তাড়াহুড়া না করে আস্তে আস্তে নেমে আসলাম ঝিরিপথে। কোমর সমান পানি ঠেলে একটা ক্যাসকেডে যেয়ে রিল্যাক্স করলাম। সবাই আসলে আবার খানিকটা সময় কাটিয়ে আরেকটা ছোটখাটো পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ঝিরিপথ পেলাম। এরপর কোন পাহাড়ে উঠা লাগে নাই। ঝিরিপথট দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিলো। কয়েকটা জায়গায় কোমর সমান পানির মধ্যে দিয়ে পার হলাম। একটা জায়গায় দেখলাম তিনটা পাহাড়ি গয়াল। গয়ালগুলোর শরীরের গড়ন খুবই জোশ। একটা গুঁতা মারলে আমি শেষ, আর আমাদের দিকে তাকানোর ভঙ্গিটাও ভালো লাগতেছিলো না। তাই দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম।
ট্রেকিং করার সময় অনেকগুলা ক্যাসকেডের দেখা পেলাম। এর মধ্যে একটাকে নাফাখুমের স্মল ভার্সন বলে মনে হল। কাছাকাছি যাবার উপায় ছিলো না, পানি অনেক। ছবি তুলতে থাকার কারণে আমরা কয়েকজন পিছনে পড়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই দূর থেকে তিনাপ সাইতারের পানির শব্দ কানে এলো। হঠাৎ আমাদের দৃষ্টিসীমার মাঝে ধরা পড়লো তিনাপ সাইতার। এর সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। গাইড দুইজন অনেক আগেই চলে গেছে। বিরাট বিরাট পাথরের মাঝ দিয়ে তিনাপের পানির ধারা এই দৃশ্য দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। আগের মেম্বাররা কোন পথে গেছে খেয়াল করি নাই ফলে পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না যাবার। শেষে একটা বিরাট পাথরের উপরে উঠলাম, সাথে অন্যদেরকে টেনে তুললাম। তারপর সেখান থেকে নেমে কোমর সমান পানি পার হয়ে ঝর্ণার নিচে গেলাম। এখানের পাথরগুলো অনেক পিচ্ছিল। তাই সাবধানে পা ফেলতে হল। ঝর্ণার পানিতে গা ভিজালাম। তীব্রভাবে পানি পড়ছে, ভেবেছিলাম বর্ষার শেষ তাই পানি অনেক কম পাবো। কিন্তু তার তুলনায় অনেকগুন বেশি পানি পেয়েছি। এত জোরে পানি পড়ছে যে ঝর্ণার পানির নিচে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন। সেখান থেকে সরে আসলাম। ঝর্ণার সামনেই একটা গাছের গুড়ি পড়ে আছে। সেটার উপর বসে দুই পা দুই দিকে রেখে আস্তে আস্তে আরেকটা পাথরে আসলাম, পাথরটা ঝর্ণার একেবারে সামনে এবং অনেক পিচ্ছিল। সেখানে এসে ঝর্ণার পানিতে আবার ভিজলাম। হঠাৎ একজন বললো ভাই দেখেন রংধনু। প্রথমে নিজের চোখখে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ভুল দেখছি ভেবে একটু চোখটা কচলালাম। কিন্তু না! ভুল দেখছি না। এ যে সত্যি সত্যি রংধনু। এ যেন বোনাস পাওয়া। সামনে দেখে রংধনু দেখতে অনেক বেশি ভালো লেগেছে। দুইটা রংধনু ছিলো। ছবি তুলে নিলাম। পানির শীতলতায় অমানুষিক ট্রেকিংয়ের কষ্ট যেন ধুয়ে মুছে গেল, মনেই হল না এত্ত কষ্টকর একটা ট্রেকিং করে এসছিলাম আমরা।
এরপর ফেরার পালা। ফিরে যেতে ইচ্ছে করতেছিলো না। গাইড ও ট্যুর মেম্বারদের বারবার ডাকাডাকির ফলে ঝর্ণার নিচ থেকে চলে আসতে হল। একেবারে শেষ পর্যায়ে ফিরার সময় সোহাগ ছেলেটা অসাবধানতার কারণে পিচ্ছিল পাথরে একটা আছাড় খেলো। ব্যথা ভালোই পেয়েছিলো। তারপর ফেরার জন্যে রওয়ানা দিলাম। সামনেই ফেরার রাস্তাটা একটা অন্যতম ভয়ংকর রাস্তা। রাস্তাটা ৯০ ডিগ্রী খাড়া। উপর থেকে নিচের দিকে একটা বাঁশ আর গাছের শিকড় আছে উঠার জন্য। উঠার জন্য পায়ের ভূমিকার চেয়ে হাতের ভূমিকাই বেশি এখানে। হাত দিয়ে বাঁশ আর শিকড় ধরে শরীরটাকে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে দিতে হবে তারপর উঠে যেতে হবে। উপরে গাইড থাকায় একটু সুবিধা হয়েছিলো। কিন্তু আগে কয়েকজন যাওয়ার ফলে রাস্তাটা ভিজে পিচ্ছিল হয়ে গেছিলো। উঠলাম আল্লাহর রহমতে। কোনমতে নিচে পড়লে আর হাড়গোড় আস্ত থাকতো বলে মনে হয় না। উপরে উঠার পর একটা জায়গায় নামতে হয়। জায়গাটা এখানেও পিচ্ছিল। এক ছোট ভাইকে বললাম সাবধানে পা ফেল। বলা শেষ করি নাই এর মধ্যেই ধপাস করে আছাড় খেলো ও। উপরের এই জায়গা থেকেই তিনাপ সাইতারের পানিগুলো নিচের দিকে পড়ছে। এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে যাবার জন্য তিনটা বাঁশ সোজা করে রাখা আছে। মাঝে পানি প্রচণ্ড গতিতে বয়ে যাচ্ছে। একবার পা ফসকালে তিনাপ সাইতারের নিচে যেয়ে পড়তে হত। গাইড দুইজন অনেক আগেই সামনে চলে গেছে। আমাদের জন্যে আর অপেক্ষা করে নাই। গুটি গুটি পায়ে পাড় হলাম। আশা ছিলো উপর থেকে তিনাপ সাইতারের নিচের দিকটা দেখবো। কিন্তু সামনে এগিয়ে যাবার পর দেখলাম পথ নেই। যেতে হলে অনেক রিস্ক নিয়ে যেতে হবে। লাইফ রিস্ক নেয়ার ইচ্ছা নেই তাই ফিরতি পথ ধরলাম। কিছুক্ষণ পর ঝিরিপথ শেষ হয়ে গেলো। এরপর শুধু পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা। মাঝে মাঝে সমতল পথ পেলে খুবই খুশি লাগতো। হেটে চললাম, এ চলার যেন আর শেষ নেই। প্রায় ৬০-৭০ ডিগ্রী খাড়া পাহাড়। সাগরকে দেখলাম খাড়া পাহাড়ে উঠার পথে এক জায়গায় বসে আছে। লাইফে ফার্স্ট টাইম ট্রেকিংয়ে এসে এমন অবস্থা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তারপরেও ছেলেগুলা মনের জোরে ট্রেকিং করছে। ওকে বলালাম রেস্ট নিয়ে তারপর আসতে। খাড়া রাস্তাটা আরো খানিকটা পাড় হয়ে একটা জায়গায় এসে বসে পড়লাম, পা আর টানতেই পারছিলাম না। স্যান্ডেলের নিচ থেকে দেখলাম রক্ত ঝরছে, নিশ্চয়ই জোকের কাজ এটা। কিন্তু জোকটাকে খুঁজে পেলাম না। নিশ্চয়ই রক্ত খাওয়া শেষে পড়ে গেছে। সেদিকে কর্ণপাত না করে সাথে থাকা গ্লুকোজ পানি, ম্যাঙ্গো বার, বিস্কুট, খেজুর, ছোলা যার কাছে যা ছিলো খেয়ে কিছু শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম। তারপর আবার নন-স্টপ হাটা শুরু করে দিলাম।
তিনাপ থেকে রওয়ানা দিয়েছিলাম ১ টার দিকে, আত্তাপাড়া এসে পৌঁছাতে ৩/৩.১৫ টা বেজে গেলো। একটা দোকানে বসে কেক-কলা-বিস্কুট যে হাতের সামনে যা পাচ্ছে তাই খাওয়া শুরু করে দিছে। জিপ আসার অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিন্তু জিপ আসতে অনেক লেট হল। লেট হয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছিলো ততক্ষণে সবার সাথে পরামর্শ করে রাতে আত্তাপাড়া থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিছি। বিকালটা আত্তাপারা খেলার মাঠেই কাটিয়ে দিলাম। সেখান থেকে কমলা, পেঁপে খেলাম। মেঘের খেলা আর সূর্যাস্ত দেখলাম। সারাজীবন মনে থাকবে এই বিকালের কথা। সন্ধ্যা হয়ে এলে পাশের একটা ঝিড়িতে যেয়ে হিম শীতল পানিতে গোসল করতে গেলাম, মাথার উপর সুন্দর ফুল মুন। ভয়ানক সুন্দর। গোসল করে এসে কাপড়চোপড় চেঞ্জ করলাম। মামুন ভাই দুপুরে ছোট ভাইয়ের সেই আছাড় খাওয়ার ভিডিওটা লাকিলি ক্যাপচার করে ফেলেছিলো সেটা দেখে হাসতে হাসতে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেলাম। আহারে বেচারা। :P সবাই মাঠে যেয়ে জোছনার আলোয় আড্ডা দিচ্ছে আমরাও বের হলাম। দেখলাম ওরা জড়ো হয়ে বসে আছে আর একটা পাহাড়ি লোক ওদের সাথে কথা বলছে। ইংরেজিতে কথা বলছে এবং একই কথা সে বারবার বলে চলেছে। মনে আছে এতটুকু সময়ের মাঝে “ফুল রেস্পন্সিবল” কথাটা তার মুখ থেকে ১৫-২০ বার শুনেছি। সন্দেহ হওয়াতে তার সামনে যেয়ে কথা শুনার চেষ্টা করলাম, যা বুঝলাম লোকটা মাতাল। এবং আমাদের বারবার ড্রিঙ্কস করার জন্যে ইনডিরেক্টলি আভাস দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের ঐসব অভ্যাস নেই তাই আর পাত্তা দিলাম না। ওখান থেকে উঠে রুমে আসলাম সবাই রাতের খাবারের জন্যে। আমার জীবনে খাওয়া সবচেয়ে বাজে খাবারের তালিকায় প্রথমে থাকবে এইটা। >:( খাবারের আর বিবরণ নাইবা দিলাম। ঢাকায় কোন জায়গায় টাকা দিয়ে এই খাবার খেতে হলে নিশ্চিত মাইর খাইত আমাদের হাতে। খাবার শেষ করার পর সবাই ঘুমাতে গেলাম। ৯ জন ঠিকমত জায়গা হল আর বাকি ৩ জনের বেশি কষ্ট হইছে ঘুমানোর জায়গা না পাওয়ায়। অনেক ক্লান্ত ছিলাম তাই সাগরের নাক ডাকার শব্দ অগ্রাহ্য করেই ঘুম দিলাম। শান্তির ঘুম।
......চলবে। (এরপরের এলবামে বলবোঃ বগালেক ও কেওক্রাডং সামিট এর গল্প।)
Hit The Trail : BogaLake & Keokradong)
১৩-১৪ অক্টোবর, ২০১৬।