হাঙরের নাম শুনলেই সবার মধ্যে ভয়ের একটা অনুভূতি কাজ করে। বিভিন্ন সিনেমায় এই প্রাণীটাকে একতরফাভাবে মানুষ খেকো হিসেবেই দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমরা কি জানি, হাঙর খুব কমই ক্ষতি করে মানুষের। জেনে নেওয়া যাক হাঙর সম্পর্কে এরকমই কিছু অজানা কথা:
১. হাঙরের কবলে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তারচেয়ে অনেক গুণ বেশি হাঙর হত্যা করেছে মানুষ। বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর গড়ে ছয়জন মানুষ হাঙরের কবলে নিহত হয়। আর মানুষের হাতে প্রতি বছর মারা পড়ে সাত থেকে দশ কোটি হাঙর।
২. কেবল তিন প্রজাতির হাঙর মূলত মানুষকে কামড়ায় এবং মারাত্মক জখম করে। বিজ্ঞানীরা বলেন পৃথিবীতে ৪০০’রও বেশি প্রজাতির হাঙর রয়েছে। এরমধ্যে বুল শার্ক, টাইগার শার্ক এবং হোয়াইট শার্ক বিপদজনক। হাঙররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৌতুহল থেকে মানুষকে কামড়ায়, শত্রুতা থেকে নয়।
৩. যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি হাঙরের আক্রমণ ঘটে। এ ধরনের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে ফ্লোরিডায়। ২০১৭ সালে সেখানে ৩১ জন হাঙর আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তবে কেউ নিহত হননি। বিশ্বজুড়ে ২০১৭ সালের পর থেকে পাঁচজন হাঙর আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন।
৪. অস্ট্রেলিয়ার কিছু হাঙর প্রবণ উপকূলে ড্রোন বা হেলিকপ্টারের সাহায্যে হাঙরের ওপর নজর রাখা হয়। কেপটাউনের উপকূলে হাঙর দেখা গেলে সৈকতে বিশেষ সতর্কতামূলক পতাকা টাঙানো হয়। কোনো কোনো সৈকতে হাঙরের প্রবেশ ঠেকাতে বিশেষ বেড়া বসানো হয়। এসব কারণে হাঙরের আক্রমণ অনেক কমে গেছে।
৫. প্রাণী সংরক্ষণবাদীদের দাবি হাঙর মানুষের জন্য যতোটা হুমকিজনক তারচেয়ে হাজার গুণ হুমকিতে রয়েছে হাঙর মানুষের দ্বারা। বংশবিস্তারের চেয়ে অনেক বেশি হারে হাঙর মেরে ফেলা হচ্ছে। হাঙরের লেজ দিয়ে মজাদার স্যুপ হয় বলে সমুদ্র থেকে হাঙর শিকার করে লেজ কেটে নেয় অনেকে। আবার অন্য মাছ শিকারের সময় জালে অনেক সময় হাঙর ধরা পড়ে। সবচেয়ে কম বিপদজনক হাঙর গচ্ছে হোয়েল শার্ক। এরা প্লাংকটন খায়। ২০১৬ সালে এই প্রজাতিটিকে বিপন্ন ঘোষণা করা হয়।
৬. হোয়েল শার্ক পৃথিবীর বৃহত্তম মাছ। এর দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট এবং ওজন ২০ টনেরও বেশি হতে পারে। এদের দাঁত থাকলে খাওয়ার জন্য জন্য মোটেই বিপদজনক নয়। কিছু স্কুবা ডাইভিং ট্যুরিজম কোম্পানি হোয়েল শার্কের সঙ্গে সাঁতার কাটার সুযোগ করে দেয় পর্যটকদের জন্য।
৭. হাঙর বেশ বুদ্ধিমান। বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেন, দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলের একদল গ্রেট হোয়াইট শার্ক সিল মাছের বাচ্চা শিকার করতে প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ফিরে আসে। সিলরা পানিতে বেশ চটপটে, পানিতে এদের ধরা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু হাঙরেরা ঠিকই সিলের দুর্বলতাটা মাথায় রেখে আক্রমণ করে এবং সফল হয়।
৮. সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে হাঙর। এরা মূলত খায় বড় আকারের শিকারি মাছ ও সিল, যারা খাদ্যের জন্য অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির মাছ ও পোকার ওপর নির্ভরশীল। এই ছোট মাছগুলোর খাদ্য বিভিন্ন উদ্ভিতকণা বা শেওলা। এখন হাঙর যদি না থাকে তবে বড় আকৃতির শিকারি মাছ ও সিলের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এরা ছোট মাছ ও পোকাদের খাওয়া শুরু করবে, ফলে ছোট মাছ ও পোকার সংখ্যা কমে যাবে। সামুদ্রিক উদ্ভিতকণা বা শেওলার ওপর নির্ভরশীল মাছ ও পোকাদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় শেওলার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকবে বহুগুণে। এই শেওলা সমুদ্রের তলদেশে সূর্যালোপ প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করবে এবং ফলে ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে সামুদ্রিক জীবনে।
৯. গ্রেট হোয়াইট শার্করা সারা জীবন ভ্রমণ করেই চলে। বিজ্ঞানীরা প্রায় কয়েক যুগ ধরে এই প্রজাতির হাঙরের ওপর নজর রাখতে শুরু করেন এদের গতিবিধি সম্পর্কে জানার জন্য। দেখা যায় আমেরিকার উত্তর উপকূলের হাঙরগুলো ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ভ্রমণ করতে করতে দক্ষিণে মেক্সিকো পর্যন্ত পৌঁছায়। এরপর মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরে কয়েকমাস কাটিয়ে হাওয়াইয়ের কাছাকাছি চলে আসে। ২০০৫ সালে একটি হাঙর আফ্রিকা থেকে সাঁতরে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত চলে আসে এবং আবার ফেরত চলে যায়। মাত্র নয় মাসে হাঙরটি পাড়ি দেয় ১২ হাজার মাইলেরও বেশি।
১০. কিছু প্রজাতির হাঙর কখনোই সাঁতরানো থামায় না। গ্রেট হোয়াইট, টাইগার এবং মাকো শার্ককে শ্বাসপ্রশ্বাস চালানোর জন্য সবসময় সাঁতরাতে হয়।