লাল সাইকেল

in #shaonashraf5 months ago

আজ ছাব্বিশ রমজান শেষ হলো।আসাদ মিয়া বেতন বোনাস পেয়েছে।বাসায় এসে প্রথমে তার স্ত্রীকে ফোন দিয়েছে।ফোনের ঐ পাশ থেকে হ্যালো বলার সাথে সাথে আসাদ মিয়া বলে উঠলো মোবারকের মা বেতন বোনাস পাইছি।কাল শেষ ডিউটি,তাই ভাবতাছি ডিউটি থেকে আইসা মোবারকের সাইকেল কিনতে যাবো।গত সপ্তাহ দেইখা আইলাম,দশাজারের মতো লাগবো।মোবারকের প্যান্টশার্ট,তোমার শাড়ি কিনেছি। আমার একটা পাঞ্জাবিও কিনছি।কাল সন্ধ্যায় সাইকেল কিনতে পারলে পরের দিন সকাল সকাল রওনা দিবাম।

এতক্ষণ একটানা কথা বলে আসাদ মিয়া থামলো।সঙ্গে সঙ্গে ঐপাশ থেকে তার স্ত্রী বলতে লাগলো।এতো টাকা দে সাইকেল কিনলে বেতন বোনাস প্রায় শেষ। ঈদে বাড়িতও খরচ আছে।পরে কুলাইতে পারতা না।সাইকেল কিনা লাগবো না।

কি বলো তুমি!গরিবের অভাব সারা বছর, এই জন্য আমার বাপজান আমারে কইছে ঈদের সময় লাল সাইকেল নিতে।আমি নিবো না।কষ্ট তো আমরা সবসময় করি। এই জন্য কি হয়ছে আমরা তিনজন একসাথে নতুন জামা কাপড় পড়ে ঈদ করবো,আমার বাপজান মনের আনন্দে লাল সাইকেল চালাবো তখন আমাদের থেকে সুখী লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।বলে অট্টহাসি দিয়ে স্ত্রীকে বললো কি বলো মোবারকের মা ঠিক বলিনি।হ ঠিকই কইছো।এরপর ফোন রেখে দিলো।

নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা আসাদ মিয়া এসএসসি পাস করার পর মা বাবার অভাবের সংসারের হাল ধরতে ঢাকা গিয়ে ফ্যাক্টরিতে কাজ নেয় সেই পনেরো বছর বয়সে।সে ছিলো তার মা বাবার বৃদ্ধ কালের একমাত্র সন্তান।নিঃসন্তান পিতা মাতার ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছিলো আসাদ মিয়া।খুব আদরে বড় হলেও অভাব তার ভালো লাগতো না।তাই মা বাবাকে বুঝিয়ে সেই ছোটবেলায় ঢাকায় কাজ করতে যাওয়া।

ফ্যাক্টরিতে কাজ করে ঘর পাকা করেছে। জমি বন্ধক রেখেছে।কিন্তু সব গুছিয়ে আনার আগেই তার বাবা মারা যায়।এরপর তার মা পাত্রী দেখে বিয়ে দেয়। বিয়ের এক বছর পর মোবারকের জন্ম হয়।মোবারকের বর্তমান বয়স ছয় বছর।ওর যখন সাড়ে তিন বছর বয়স তখনি দাদীও মারা যায়।তাই এখন ওরা তিনজনই আপনজন।মোবারক আসাদ মিয়ার জীবন।রোজার আগে যখন ছুটিতে বাড়িতে আসে মোবারক তখন বায়না ধরে ঈদের সময় তার লাল সাইকেল চাই।তাই রোজার একমাস যতটা পেরেছে ওভারটাইম করে একটু বেশি উপার্জনের চেষ্টা করছে।আজ ঈদের আগে বেতন বোনাস ওভার টাইম সব পেয়েছে। তাই নিয়ে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলছিলো।সেহরির সময় আবার ফোন।
দিনে সময় হবে না কথা বলার।চিন্তা করো না।ডিউটি শেষ হলে আগে সাইকেল কিনতে যাবো।কি রান্নাবান্না হয়ছে এসব কথা বলে রেখে দেয়।

পরের দিন ডিউটি শেষ করে সাইকেল কিনে নিয়ে বাসায় এসে ইফতার করলো।এরপর আবার চলে গেলো বাকী কিছু কিনাকাটা ছিলো তাই করতে।সেমাই,মসলা সবই ঢাকা থেকে নিয়ে যাবে তাই। এসব কিনে নয়টার দিকে বাসায় এসে ভিডিও কল করে ছেলেকে সাইকেল দেখাচ্ছিলো আসাদ মিয়া।হঠাৎ বুকের বামপাশে ব্যাথা অনুভব করলো।প্রথমে কিছু মনে করেনি।আস্তে আস্তে বাড়ছে দেখে বউকে বলছিলো বুকে ব্যাথা করছে কেনো জানি, এখন রাখো পরে ফোন দিবো।

বুকের ব্যাথা বাড়ছে সহ্য করতে পারছে না।বুকে যেন কেউ চাপ দিচ্ছে এমন মনে হচ্ছে আসাদ মিয়ার।ওর রুমমেটকে বলছে কি করি বলতো।সামনের ক্লিনিক থেকে ডাক্তার দেখিয়ে আসি চলো।আসাদ মিয়া হেসে বলে উঠলো কি যে বলো এই একটু ব্যাথা নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাবো।সকাল সকাল বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেবো।দেখি একটু পানি খেয়ে শুয়ে পড়ি।রুমমেট কোন একটা দরকারে বাইরে চলে গেলো।এক ঘন্টা পর বাসায় ফিরে দেখে আসাদ মিয়া অচেতন অবস্থায় নিচে পড়ে আছে। তৎক্ষনাত হাসপাতালে নিয়ে গেলো।ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেছে।ডাক্তার আসাদ মিয়াকে মৃত ঘোষণা করলেন।ঈদের আগের দিন যেমন কথা ছিলো বাড়িতে লাল সাইকেল আসবে তেমন এসেছে কিন্তু আসাদ মিয়া এসেছে ট্রাকে করে লাশ হয়ে।

আসাদ মিয়ার বউ কেঁদে কেঁদে এসব বলে মূর্ছা যাচ্ছে আবার চেতনা ফিরে পাচ্ছে আবার বলতে শুরু করেছে।মোবারক মায়ের সাথে কখনো কাঁদে,কখনো বাবার লাশের পাশে বসে থাকে কখনো বা আবার লাল সাইকেলের গায়ে হাত বুলায়।সে জানে না তার পায়ের নিচের মাটি আজ চোরাবালিতে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ করতে করতে তাকে বাকী পথ পারি দিতে হবে।নিরাপত্তার যে চাদরে ঢাকা ছিলো তার জীবন তা আজ ছিন্নভিন্ন।

Screenshot_2024_0822_232405.png