ভালোবেসে সব ছেড়ে যে হাত ধরে ছিলো আজ সে হাত ধরে রাখার মতো কোনো কারণ রিমি খুঁজে পায়না।কি করবে সে? ভাবতে ভাবতে কখনো ফিরে যায় শৈশবে কখনো কৈশোরে। আজ তিন দিন হলো বাসায় রান্না হচ্ছে না। মুকুল মানে রিমির স্বামী বাসায় আসেনা আজ পাঁচদিন। প্রথম দুইদিন রিমি রান্না করে অপেক্ষা করেছে কিন্তু আসে না। তাই তিন দিন যাবৎ আর রান্নাও করছে না।
নিজে খিদে পেলে মুড়ি,পানি এইসব কম কম খেয়ে থেকে যায়।বাবার বাড়ি ফিরে যাওয়ার দরজা বন্ধ। না সেটা রিমির বাবা মা বন্ধ করে দেয়নি। রিমির আত্মসম্মানবোধ সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। যে বাবা মায়ের মুখে চুনকালি মেখে একদিন মুকুলের হাত ধরেছিলো আজ কিভাবে সে বাবা মাকে বলবে সে হাত আজ তাকে মুক্তি দিতে চায়।পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র ছোট বোন রিমি ছিলো পরিবারের প্রাণ ভোমরা।
বাবা গ্রামের চেয়ারম্যান। বড় তিন ভাই ব্যবসা করে, এক ভাই ব্যাংকে চাকরি করে।সবার ছোট যে সে অনার্স এ পড়ে।রিমি তার সাত বছরের ছোট।এলাকার লোক রিমিকে অনেকটা রাজকন্যা র মতো ভাবে।চাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া নিয়ে বড় হচ্ছিল সে।রিমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সে স্কুলে যায় সবার থেকে আলাদা ভাবে।বনেদি বনেদি গন্ধ লেগে থাকে তার গাঁয়ে।
অষ্টম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার পর ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে যায়।সেখানে মুকুল নামের একটা ছেলে তাকে দেখেছে। রিমি দেখেনি।সেই ছেলের নাকি রিমিকে পছন্দ হয়েছে। সে আবার সেখানকার মেম্বারের বখাটে ছেলে।কার কাছে জিজ্ঞেস করে রিমির স্কুলের নাম জেনে নিয়েছে।পাশাপাশি উপজেলা খুব বেশি দূর নয়।এরপর মুকুল প্রায়ই রিমির স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে।একদিন সুযোগ বুঝে প্রেমের প্রস্তাব দেয়।রিমি প্রথমে রাজি না হলেও দশম শ্রেণির প্রথম দিকে ওদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
মুকুল দুই বছর আগে এসএসসি পাশ করে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। বাবাকে চাপ দিয়ে একটা মোটর সাইকেল কিনে নিয়েছে। এটা নিয়ে ভাব মেরে ঘুরাঘুরি করে। স্কুলের রাস্তা আর মাঝে মাঝে মার্কেটে দেখা করে তারা। এভাবে দুই বছর কেটে যায়। সম্পর্কে গভীরতা আসে। বাংলা সিনেমা ভক্ত রিমি বাংলা সিনেমার মতো কাজ করে।রিমি যখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে তখন তারা পরিকল্পনা করে দুজন পালিয়ে যাবে।
রিমি তার সমস্ত গয়না জামা কাপড় প্যাক করে বাবার আলমারি থেকে এক লক্ষ টাকা নগদ নিয়ে একদিন রাতে বের হয়ে যায়।ওরা সরাসরি ঢাকা চলে আসে।অবশ্য মুকুল পালিয়ে যাওয়ার দুই মাস আগেই ঢাকা এসে থাকতে শুরু করে।
ঢাকা থেকেই রিমিকে নিতে আসে।একটা রুম ভাড়া নিয়ে তাতে একটা খাট, কিছু হাঁড়ি পাতিল, একটা আলনা এসব মুকুল কিনে রেখেছিলো।রিমিকে নিয়ে ঢাকা এসে বিয়ে করে কাজী অফিসে। মুকুলের বন্ধুদের সাক্ষী হিসেবে নিয়ে যাওয়ায় বিয়ে করতে কোন সমস্যা হয়নি।রিমির বাড়ির সবাই পাগলের মতো রিমিকে খুঁজে। ঐ ছেলের সাথে রিমির সম্পর্ক কেউ জানতো না।কারণ রিমি ওর সাথে দেখা করতো বোরকা পড়ে। তাই কেউ কোনদিন চিনতে পারেনি।রিমি এমনিতে কখনো বোরকা পড়ে না।তাই চিনার উপায় ছিলো না।
বিয়ের ছয় মাস পর মুকুল তার বাড়িতে বলে রিমিকে নিয়ে বাড়িতে আসে। তখন রিমির ফুফু জানতে পারে।তখন রিমির বাড়ির সবাই জানতে পারে।কিন্তু রিমির বাড়ি থেকে তখনও মেনে নেয়নি।
ঐসময় রিমির সুখের সংসার।রিমি যে টাকা নিয়ে গেছিলো তা দিয়ে সংসার চলেছে ভালো।আবার কিছু গয়নাও বিক্রি করেছে।বাড়িতে এক সপ্তাহ থেকে চলে যায় তারা।দুজন মিলে প্রতিদিন ঘুরতে যায়।পিকনিক করে। সীমাহীন আনন্দ।
মুকুল প্রথম থেকে একটা চাকরি করতো কিন্তু পরে আবার ঠিক মতো করে না।সপ্তাহে দুই তিন দিন মিস করে। গার্মেন্টস এর চাকরিতে এটেন্ড না করলে বেতন কেটে দেয়।বেতন ছয় হাজার, মাস শেষে কেটে পায় দুই হাজার।রিমি বাড়ি থেকে প্রায় পনেরো ভরি অলংকার এনেছিলো।
প্রতিমাসে কিছু বিক্রি করে সংসার চালায়।বছর না ঘুরতেই অলংকার শেষ।এবার শুরু হলো অভাব।মুকুল যা বেতন পায় তা থেকে বাসা ভাড়া দিয়ে আর সংসার চলে না।মুকুল এবার প্রায়ই রিমিকে বলে চলো তোমাদের বাড়িতে যায়।ভাইয়েরা যদি আমাকে একটা ব্যবসা ধরিয়ে দেয় তাহলে আর সমস্যা থাকবে না।রিমি যাবে না।রিমি ভাবতেও পারে না মুকুল একথা বলতে পারে।এনিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া। এক পর্যায়ে মুকুল রিমির গায়ে হাত তুলে।তাও রিমি সহ্য করে নেয়।
এভাবে আরও ছয় মাস চলে গেলো।এখন ঝগড়া হলে মুকুল রাতে বাসায় আসে না।কোথায় থাকে রিমির জানা নেই।তবে সকালে আবার চলে আসে।এবারও রিমি তাই ভেবেছিলো। কিন্তু না পাঁচদিন হয়ে গেলো মুকুল আসছে না।রিমি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
সে জানে বাড়িতে ফিরে গেলে বাপভাই তাকে ফেলবে না।কিন্তু কোন মুখে যাবে আজ সে বাপভাইয়ের সামনে।রিমির ভাইদের সামনে গিয়ে চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই।তাই নিজের হাতে সাজানো সংসারের ফ্যানটাকেই নিজের শেষ আশ্রয় করে নিয়ে এ পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছে।মা বাবাকে কষ্ট দিয়ে কোনো সন্তান সুখী হতে পারে না রিমি তার বাস্তব উদাহরণ।