নিশাচর

"সকাল সকাল ঘুমায় যারা সকাল সকাল জাগে,জ্ঞান বিদ্যা স্বাস্থ্যে তারা থাকে সবার আগে।"এ চরণ দুটি শুনেনি এমন শিশু খুঁজে পাওয়া মুশকিল।কারণ আমরা চার ভাইবোনই শুনেছি।তবে সমস্যা হচ্ছে আমরা ভাইবোনেরা এই কাজটা করতে পারি না।আমাদের আম্মাজান সব ভালো অভ্যাস গুলো ধরে শিখাতে ভুলেননি কিন্তু এই অভ্যাসটা তিনি করাননি।তার কারণ হচ্ছে আমাদের কষ্ট হবে।

আমরা যখন আম্মার কাছে থাকি তখন আম্মা আমাদের দিয়ে দুটি কাজ করান। নাম্বার ওয়ান খাওয়া,নাম্বার টু ঘুম। ছোট বেলা থেকে আম্মা আমাদের ভালো থাকা নিয়ে সচেতন। আমরা তিন বোন যখন বাড়িতে ছিলাম, অনেকে বলতো আম্মাকে, তিন তিনটে মেয়ে রেখে কেটে মরার কি দরকার,রান্নাটা মেয়েদের দিয়ে করালে কি হয়।আম্মা তখন হাসি দিয়ে বলতো মেয়ে হয়ে জন্মেছে রান্না তো করবেই এখন একটু মায়ের রান্না খেয়ে যাক।আম্মার ধারণা এইরকমই ছিলো।

আবার এইজন্য এমন নয় যে আমরা কাজ পারি না। কাজ সবই পারি শুধু সকালে ঘুম থেকে উঠাটা শিখতে পারিনি।মাঝে মাঝে একেকদিন ওঠে গেলে খুব ভালো লাগে।তখন মনে মনে বলি এখন থেকে প্রতিদিন ভোরে উঠবো।কিন্তু পরদিন আর মনে থাকে না। আমাদের একজন ভাবি আছে সে প্রতিদিন ফজরের আযানের আগে ওঠে যায়।ওনি ওঠার পর ফজরের আযান দেয়।

সকালে দেরীতে উঠার সাথে আমাদের আরেকটা বদঅভ্যাস আছে সেটা হলো দেরীতে ঘুমানো।আমি দুইটার আগে ঘুমাই না। তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। মানহা আর ওর বাবা ঘুমিয়ে যায় পরে আমি যা করি আমার ইচ্ছে। শাওন পড়াশোনা করে ওরও কোনো সমস্যা নেই। বড় আপার একি অবস্থা আগে ঘুমাইলেও সমস্যা নেই পরে ঘুমাইলেও সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ছোট আপার। ওর স্বামী সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে যাবে।

এখন ছোট আপা ওর মতো যা করার করে একটু রাতে ঘুমাতে আসে।এখন ওর স্বামী একদিন আমাকে বলছে,ও নিশাচর যত রাত বেশি হয় তত ওর চোখ পরিস্কার হয়।কথাটা আমার খুব ভালো লেগেছে। ওনি যে অর্থেই বলেন তাতে আমার কিছু যায় আসে না।সকালে ঘুম থেকে উঠা ভালো,সকাল সকাল ঘুমানোও ভালো,তা আমিও মানি কিন্তু সজাগ থাকলেও কিছু সুবিধা আছে।এর প্রথম সুবিধা হচ্ছে নিস্তব্ধ পৃথিবী।

এই নিরব নিস্তব্ধ পৃথিবী শুধু গভীর রাতেই সম্ভব। করোনা আসার পর থেকে এ নিস্তব্ধতা অনেক বেড়েছে।দিনের আলোতে যা ভাবা যায় না রাতে তা অতিসহজে করে দেওয়া যায়।আমরা ষোল তলায় থাকি । আমার বেড রুম থেকে দুই দিকের রাস্তা দেখা যায়।একটা হাইওয়ে। সারাদিন সেকেন্ডের জন্য থামে না গাড়ি চলা।বিদুৎ গতিতে ছুটে চলে রং বেরঙের গাড়ি। মাঝে মাঝে দেখলে কষ্ট হয়।অনবরত গাড়ির ভার বহণ করে রাস্তাটা যেনো পিষে মরছে।রাত একটার পর দৃশ্য পাল্টে যায়।

নিরব নিস্তব্ধ শান্ত রাস্তা গুলোকে মিষ্টি আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে ল্যাম্পপোস্ট।মায়ায় জড়ানো রাস্তার পাশে থাকা গাছগুলো হেলেদুলে নৃত্য করছে।গাছের নৃত্যের তালে তালে যে মিষ্টি হাওয়া সৃষ্টি হচ্ছে তার কিছু অংশ বয়ে আসছে আমার জানালার ফাঁক গলে।চোখ আর মনের সাথে শরীরটাও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে পরম শান্তিতে।গভীর রাত ছাড়া এ অনুভূতি কখনো পাওয়া সম্ভব নয়।আর যেদিন আকাশে গোল একটা সোনালী চাঁদ থাকে সে সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করার ভাষা আমার জানা নেই।

আবার ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনার উপযুক্ত সময় এটা।সব ধরনের ঝামেলা ঝেড়ে ফেলে পড়াশোনায় পূর্ণ মনোনিবেশ করা গভীর রাতেই সম্ভব অন্য কোন সময় তা সম্ভব নয়।এছাড়াও লেখকদের লেখার উপযুক্ত সময়ও এই গভীর রাত।সৃজনশীল কোন কিছু সৃষ্টির জন্য পূর্ণ মনোযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর গতিশীল এই ঝঞ্জাট পূর্ণ পৃথিবীতে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করতে হলে নিরব নিস্তব্ধ সময়ের প্রয়োজন।আর এই সুন্দরতম পরিবেশ শুধু গভীর রাতেই সৃষ্টি হয়।

IMG_20230306_212313.jpg