যাযাবর জীবন!

মেয়েদের জীবনটা বড় অদ্ভুত।অনেকটা ভাসমান। ছোট থেকে সে যে পরিবেশে বড় হয় সেখান থেকে অনেক কিছু শিখে কিন্তু এগুলো সে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবে কিনা অনিশ্চিত।

আমাদের ফুফুদের অবস্থা দেখে আজ হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারি না।মাঝে মাঝে আমার মজা লাগে, আবার মাঝে মাঝে কষ্টও লাগে।আমার দাদা ছিলেন মাওলানা। আমার বড় ফুফুর বিয়ে হয়েছিলো অনেক দূর। মানে আমাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জ আর আমার বড়ফুফুর স্বামীর বাড়ি নেত্রকোণা।তিনি আমার জন্মের অনেক আগেই মারা গেছেন।তাই ওনার সম্পর্কে খুব বেশি জানি না।ওনার স্বামী ছিলেন টাইটেল পাস বড় মাপের আলেম।হয়তো সেখানে গিয়ে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলো।

এবার আসি বাকী তিনজনের কথায়।ওনাদের দুই জনের বিয়ে হয়েছে আমাদের উপজেলার ভিতরে ভিন্ন দুই গ্রামে, আর ছোট ফুফুর বিয়ে হয়েছে আমাদের পাশের উপজেলায়।আমার দ্বিতীয় যে ফুফু তার বিয়ে হয়েছে আমাদের বাড়ি থেকে এক মাইলের মতো দূরে। ওনার স্বামী তেমন বেশি শিক্ষিত ছিলেন না।মাঠে অনেক জমি আছে কৃষি কাজ করতেন। ওনার তিন ছেলে তারা সবাই বাংলা শিক্ষিত মানে স্কুল কলেজে পড়েছে।

এরপরে যিনি তিনি ছিলেন মাস্টার্স পাস উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।উনারও তিন ছেলে দুই মেয়ে।তাদের দুইজন মাদ্রাসায় পড়েছে, একজন কোরআনের হাফেজ আর দুইজন বাংলা শিক্ষিত। এরপর যে ফুফু, ওনার স্বামী আবার টাইটেল পাস মাওলানা। ওনার চার ছেলে এক মেয়ে।ওনার ছেলেদের হাফিজি লাইনে পড়ালেখা করিয়ে আলেম বানিয়েছেন।

কি জন্য এই পরিচয় পর্ব এখন মূল কথাই আসা যাক।আমার তিন ফুফুর স্বামী তিন ধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শের।আমাদের ফুফুদের যখন খুব কম বয়সে বিয়ে হয়েছে তাই তারাও স্বামীদের কাছ থেকে এসব বিষয় শিখেছে। এখন তিন বোন এক সাথে হলে তাদের মত কখনো এক হতো না।

এবার আসি ধর্মীয় ব্যাপারে। আমরাও মুসলমান ওরাও সবাই মুসলমান। কিন্তু আমার ছোট ফুফুর ছেলেরা আলেম আর মেজু ফুফুর জামাই ছিলেন পীর ভক্ত। ওনার পীর যখন মারা যান তখন ওনাকে ঐ দায়িত্ব দিয়ে যান।এরপর থেকে তিনি পীর।বাড়িতে ওরস হয়,মাহফিল হয়।ছেলেরাও বাপের বিশ্বাসে বিশ্বাসী।আর বড় ফুফুর ছেলেরা জীবনের বাস্তবতা নিয়ে ব্যস্ত।এখন ছোট ফুফুর ছেলেরা বলে ওরস, পীর এসব নাকি ভন্ডামি।এই নিয়ে বোনে বোনে ঝগড়া না হলেও মনে মনে মিল নেই। নিজেদের মধ্যে হাজার মাইল দুরত্ব। আমাদের এলাকায় একটা কথা প্রচলিত আছে ''গাঙে গাঙে দেখা হয় তাও বোনে বোনে দেখা হয় না''।

এসব কথা যে কত সত্য বাস্তবতা নিরীক্ষণ করলে বুঝা যায়।এই যে আমরা তিন বোন। তিনজনের বিয়ে হয়েছে তিন জেলায় যদিও আমাদের কেন্দ্র বিন্দু ঢাকা।তাও কখন কে দূরে চলে যাবো তা বলা যায় না।আমার ছোটো যার পিছে পিছে ঘুরে আমি বড় হয়েছি।সেই ষষ্ঠ শ্রেনী থেকে দুই বোনের আলাদা কোনো জামা ছিলো না। সব জামা ছিলো আমাদের দুইজনের। আবার কিছু কিছু জামা আবার একি রকম।দুইজনের মনের ভিতরে কোনো গোপন কথা থাকেনি কখনো।

আমাদের ভাবনা গুলোও মিলে যেতো। তাই মাঝে মাঝে এটা নিয়ে আমরা খেলা করতাম।হঠাৎ বলে উঠতাম ছোটো আমি যা ভাবতেছি তুই কি তাই ভাবছিস সে বলতো ঠিক আছে পরীক্ষা হবে।তখন দুইজন আলাদা কাগজে লিখতাম। বেশির ভাগ সময় মিলে যেতো।যখন আমরা বাড়িতে ছিলাম রাতে দুইজন দুই টেবিলে পড়তাম মধ্যে খাট ছিলো। কথা বললে আম্মা বকা দিবে, পড়া রেখে গল্প করার অপরাধে। তাই আমরা চিঠি লেখে ঢিল দিয়ে পৌঁছিয়ে দিতাম।এভাবে কথা আদান-প্রদান হতো যতক্ষণ পড়ালেখা করতাম।

যখন ঢাকায় থাকতাম তখন দুজনেরই ফোন আছে।পাশাপাশি শুয়ে দুষ্টুমি করে মেসেজ পাঠাতাম। অনেক রাত হয়েছে ঘুমাসনি কেনো? কিংবা মোবাইল চাপছিস কেনো? এই রকম।সবচেয়ে স্পশাল ব্যাপার ছিলো ওর যা সব আমার আর আমার যা সব ওর ছিলো।

কিন্তু এখন সবই আলাদা। এখন ইচ্ছে হলেও পাশে বসে কথা বলা হয় না।এখন ওর জিনিস ওর আর আমার জিনিস আমার।বাড়ির মতো সবি আলাদা। ভাই ভাই যতই আলাদা হোক এমন হয় না। কথায় বলে ''ভাতও আলাদা, জাতও আলাদা"।বোনদের ক্ষেত্রে এ কথা ধ্রুব তারার মতো সত্য।

527-5279543_we-re-two-sisters-who-have-gone-through.png