অকৃতদার গোয়েন্দার দল!

in #newsbd7 years ago

31090a88db53d5abeffad787d3e57874-5b111305cfe21.jpg

কথাসাহিত্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র কোনটি? এমন প্রশ্নের সহজ জবাব হলো, ডিটেকটিভ তথা গোয়েন্দা চরিত্রগুলো। জনপ্রিয়তার বিচারেও তারা এগিয়ে আছে অন্য সব চরিত্র থেকে। বিশ্বব্যাপী প্রকাশনা জগতে আধিপত্য বিস্তারকারী থ্রিলার-সাহিত্যের মূল চালিকাশক্তি হলো এই সব গোয়েন্দা। পাঠকের কাছে তারা যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি কৌতূহলোদ্দীপক। এসব চরিত্র পাঠকের মনোজগতে এতটাই জীবন্ত হয়ে ওঠে যে, মাঝেমধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা তাদের¯স্রষ্টাকে ছাপিয়ে যায়। প্রথম উনিশ শতকের শেষে এ ধরনের চরিত্রের সূচনা দেখা যায় ইউরোপ-আমেরিকার সাহিত্যে, এরপর থেকে গোয়েন্দাদের উৎপত্তি আর থেমে থাকেনি। এখন বলতে গেলে পৃথিবীর খুব কম দেশই পাওয়া যাবে, যেখানে তাদের নিজস্ব এক বা একাধিক গোয়েন্দা চরিত্র নেই। ইউরোপ-আমেরিকার সাহিত্য ঘাঁটলে সাম্প্রতিক সময়েই পাওয়া যাবে কয়েক শ জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র।

শুরু থেকে বর্তমান সময়ের গোয়েন্দা চরিত্রগুলো ভালো করে খেয়াল করলে আশ্চর্যজনক একটি সাযুজ্য লক্ষ করা যায়, তাদের প্রায় কারোরই স্ত্রী নেই! এমনকি কালেভদ্রে প্রেমিকারও দেখা পাওয়া যায় না। তারা প্রায় সবাই অকৃতদার!

কিন্তু কেন?

এ প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে প্রথম গোয়েন্দা কে, কিংবা সাহিত্যের প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি কোনটি, সেটা নিয়ে একটু আলাপ করা যাক। তার আগে বলে নিই, গোয়েন্দা বা ডিটেকটিভ আর স্পাই কিংবা গুপ্তচরের মধ্যে যে তফাত আছে, সেটা যেন পাঠক মাথায় রাখেন। পিস্তল আর রিভলবারের মধ্যে যেটুকু পার্থক্য আছে তার চেয়ে অনেক বেশি পার্থক্য রয়েছে ডিটেকটিভ আর স্পাইয়ের মধ্যে। তবে দীর্ঘদিন থেকেই স্পাই আর ডিটেকটিভের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘গোয়েন্দা’র ব্যবহার পাঠকের কাছে একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করে রেখেছে। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, এ লেখাটি ডিটেকটিভ তথা গোয়েন্দাদের নিয়ে, আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র ‘স্পাই’রা এখানে ব্রাত্যজন।

যাহোক, তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা গেছে, সবচেয়ে পুরোনো গোয়েন্দা আর গোয়েন্দা কাহিনির নজির রয়েছে আরব্য রজনীর শেহেরজাদের বলা কাহিনিতে। আরব্য রজনীর এক গল্পে দেখা যায়, এক জেলে দজলা নদীতে তালাবদ্ধ একটি সিন্দুক খুঁজে পেয়ে সেটা বিক্রি করে দেয় খলিফা হারুন-অর-রশীদের কাছে। সেই রহস্যময় সিন্দুক ভেঙে পাওয়া যায় খণ্ডিত এক তরুণীর মৃতদেহ। খলিফা তাঁর উজির জাফর ইবনে ইয়াহিয়াকে নির্দেশ দেন তিন দিনের মধ্যে খুনিকে খুঁজে বের করতে হবে, নইলে তার শিরশ্ছেদ করা হবে। শেষ পর্যন্ত নানান ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে উজির তার তদন্তকাজে সফল হয়ে নিজের গর্দান রক্ষা করতে সক্ষম হয়। সেদিক থেকে দেখলে, এই গল্পটিকে গোয়েন্দা কাহিনি বলা যেতে পারে। আর জাফর ইবনে ইয়াহিয়া হতে পারে পৃথিবীর প্রথম গোয়েন্দা চরিত্র। কিন্তু অনেকেই এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। জাফর কোনো গোয়েন্দা ছিল না (অবশ্য সে সময় আদৌ কোনো গোয়েন্দা ছিল কি না, তাও জানা নেই), আর সে এ কাজ স্বেচ্ছায় বেছেও নেয়নি। তদন্তটি তার ওপর রীতিমতো চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

অনেকেই হয়তো আর্কাইভ ঘেঁটে দেখাতে চাইবেন, ১৮২৭ সালে ভিদোচের লেখা মেমোয়ার্স অব ভিদোচই প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি। তবে সে কাহিনিতে শক্তিশালী গোয়েন্দার উপস্থিতির চেয়ে বাস্তবিক কিছু হত্যা-খুনের রহস্যের জট খোলার ঘটনাই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। সেই হিসেবে প্রথম সাহিত্যিক গোয়েন্দার তকমাটা অনিবার্যভাবেই জুটে যায় মার্কিন কবি ও লেখক এডগার এলান পোর সৃষ্ট অগুস্ত দুঁপোয়ার ললাটেই। ১৮৪১ সালে লেখা মার্ডার ইন দ্য রু মর্গকেই সবাই আধুনিক গোয়েন্দা কাহিনির প্রথম গল্প হিসেবে মেনে নেয়, সেই সঙ্গে স্বীকার করে নেয় এর প্রধান চরিত্র দুঁপোয়াকে পৃথিবীর প্রথম গোয়েন্দা চরিত্র হিসেবে। বর্তমান সময়ে এলান পোকে অবশ্য বিনা বাক্য ব্যয়ে ডিটেকটিভ বা থ্রিলার জনরার প্রবর্তক হিসেবেই সবাই মানেন। সম্মানজনক ‘এডগার অ্যাওয়ার্ড’ হিসেবে গোয়েন্দা বা ডিটেকটিভ বা থ্রিলার সাহিত্যের যে পুরস্কারটি প্রবর্তিত রয়েছে মার্কিন মুল্লুকে, সেটা তাঁর নামেই দেওয়া হয়।

পোয়ের সৃষ্ট গোয়েন্দা অগুস্ত দুঁপোয়া কোনো পেশাদার গোয়েন্দা নয়, রহস্যের সমাধান করাই তার নেশা। সেই যে শুরু, এরপর থেকে যত গোয়েন্দা এসেছে, তাদের অধিকাংশই অপেশাদার, আর অবশ্যই অকৃতদার! পোয়ের পরে ফরাসি লেখক এমিল গাবোরিওর ইন্সপেক্টর লেকক অবশ্য পেশাদার, কিন্তু এলান পোয়ের প্রভাব এতটাই বেশি যে পরবর্তীকালে যত গোয়েন্দা সৃষ্ট হয়েছে তার প্রায় সবাই প্রাইভেট ডিটেকটিভ আর অকৃতদার! যেমন পৃথিবীখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস। ১৮৮৭ সালে আর্থার কোনান ডয়েল অ্যা স্টাডি ইন স্কারলেট-এর মাধ্যমে যে গোয়েন্দাকে হাজির করেন, সেটা দুঁপোর মতোই অপেশাদার। তবে শার্লক হোমস আগের সব গোয়েন্দাকে ছাড়িয়ে যায় জনপ্রিয়তার বিচারে। আজও সে সমান জনপ্রিয়। নিজের¯স্রষ্টার চেয়েও বেশি মানুষ চেনে তাকে। হোমসের পরে যত গোয়েন্দা এসেছে তারা প্রায় সবাই তার চরিত্রের প্রভাবে নির্মিত। দুঁপোর মতোই হোমসও শখের গোয়েন্দা এবং নারীবিবর্জিত! কিছু পাঠক বলতে পারেন আইরিন এডলারের কথা, কিন্তু আর্থার কোনান ডয়েল কোনো গল্পেই তার প্রতি হোমসের কোনো অনুরাগ প্রদর্শন করাননি। ও রকম কিছু যদি থেকে থাকে, সেগুলো উৎপন্ন হয়েছে অনেক পরে, হালের জনপ্রিয়তা পাওয়া হোমসের টিভি সিরিজগুলো থেকে।

ডয়েলের পর সবচেয়ে জনপ্রিয় মিস্ট্রি কুইন আগাথা ক্রিস্টিও একই পথ অনুসরণ করেছেন। তাঁর এরকুল পোয়ারোর না আছে স্ত্রী, না আছে প্রেমিকা। ক্রিস্টি তাঁর এই গোয়েন্দা চরিত্রটির পারিবারিক জীবন সম্পর্কেও সামান্যই বলেছেন। মাত্র একটি গল্পে উল্লেখ আছে, বিশাল বড় একটি পরিবার থেকে উঠে এসেছে সে, তার রয়েছে ছোট এক বোন,Ñব্যস—এ পর্যন্তই। আর নাম শুনেই বোঝা যায়, ক্রিস্টির তাঁর আরেক নারী গোয়েন্দা চরিত্র মিস মার্পলকেও রেখেছেন পুরুষবিবর্জিত করে,Ñঅকৃতদার হিসেবে!

আরেকটু আধুনিক যুগে আসি। ত্রিশের দশকে মার্কিন লেখক ড্যাশিয়েল হ্যামেট অনেকটা শার্লক হোমসের আদলে স্যাম স্পেড নামে এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ সৃষ্টি করেন, পূর্বসূরিদের মতো তিনিও তাকে রেখেছেন অকৃতদার হিসেবে। তার কি প্রেমিকা আছে? কোনো কাহিনিতে অবশ্য সে রকম কিছুর দেখা মেলে না। তবে সুন্দরী ব্যক্তিগত সহকারী কিংবা নারী ক্লায়েন্টের সঙ্গে একটু রঙ্গ-তামাশার চেয়ে বেশি কিছু পাঠক খুঁজে পাবেন না। হ্যামেটের পরে রেমন্ড চ্যান্ডলারও একই কাজ করেছেন ফিলিপ মার্লোকে নিয়ে। বেচারা অকৃতদারই থেকে গেছে।

পাশ্চাত্যে, যেখানে এই ধারার সাহিত্যের সূচনা ও বিকাশ, সেখানকার কথা বাদ দিয়ে যদি বাংলা ভাষাভাষী গোয়েন্দাদের দিকেও নজর দিই, চিত্র কিন্তু একই। এ অঞ্চলে সবচেয়ে জনপ্রিয় গোয়েন্দা ফেলুদা যেমন শখের গোয়েন্দা, তেমনি যতটুকু জানি, সেই বেচারার ভাগ্যেও প্রেমিকা জোটেনি। স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ও অন্যান্য গোয়েন্দার মতো ফেলুদাকে গড়েছেন অকৃতদার করে। তবে ষাটের দশকের পর থেকে অপেশাদার আর শখের গোয়েন্দার সংখ্যা দ্রুত কমতে শুরু করে।Ñতাদের স্থান দখল করে নেয় দক্ষ আর পেশাদার গোয়েন্দারা, যাদের রয়েছে উচ্চমানের প্রশিক্ষণ। ফলে গোয়েন্দা-সাহিত্যেও এসেছে গুণগত পরিবর্তন। সেই সুবাদে আধুনিক আর উন্নতমানের ফরেনসিক মেথড, ইনভেস্টিগেটিভ প্রসেসিংয়ের সঙ্গে পাঠক এখন পরিচিত। এখনো যে অপেশাদার আর শখের গোয়েন্দার জন্ম হয় না, তা কিন্তু নয়; তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ওগুলো অপটু হাতে লেখা, কিংবা পূর্বসূরিদের জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র থেকে হুবহু কপি করা।

প্রায় এক দশক আগে আমি নিজেও যখন ডিটেকটিভ গল্প লিখতে শুরু করি (সচেতনভাবে ওগুলোকে থ্রিলার বলেই উল্লেখ করি সব সময়), তখনো নিজের গোয়েন্দাকে পেশাদার রাখলেও অকৃতদার হিসেবেই রেখেছি। জেফরি বেগ নামে সেই বেচারার অবশ্য একজন প্রেমিকা রয়েছে, কিন্তু পাঠকের ইচ্ছের কারণেই হোক কিংবা পূর্বসূরিদের ঐতিহ্য বজায় রাখার তাগিদেই হোক, তাদের বিয়ে দিতে পারছি না এখনো! বরং পাঠকের দাবির কাছে নতি স্বীকার করলে তাদের সম্পর্কটা ভেঙেই দিতে হবে! খোদাদাদ শাহবাজ খান নামে আমার আরেকটি গোয়েন্দা চরিত্র রয়েছে, সে ডিভোর্সি। তার প্রতি অনুরক্ত এক নারী চরিত্র রয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর বেশি কিছু না। সম্ভবত অবচেতন মনে আমি নিজেও পূর্বসূরিদের চক্র থেকে বের হতে পারিনি।

কিন্তু কেন গোয়েন্দা চরিত্রগুলোর এমন হাল? কেন তারা অকৃতদার? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে, এলান পো থেকে শুরু করে তাবত লেখক অবচেতন কিংবা সচেতনভাবে একটি বিষয়ই মাথায় রেখেছেন—গোয়েন্দা চরিত্রকে আকর্ষণীয়, দৃঢ়, একরোখা আর ঝুঁকি নিতে বদ্ধপরিকর হিসেবে দেখাতে হবে।Ñআর এটা করতে গিয়ে তাদের প্রচলিত সামাজিক জীবনের গণ্ডিতে আটকে রাখা চলবে না। সমাজের মধ্যে তার বসবাস থাকলেও সে পুরোপুরি সাধারণ কেউ নয়। কোনো পিছুটান যেন না থাকে, সেভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে তাদের। স্বামী/স্ত্রী-সন্তান থাকলে হয়তো পাঠকের কাছেও মনে হতে পারে চরিত্রটি সাদামাটা। দুর্ধর্ষ খুনি আর অপরাধীর পিছু নেওয়ার মতো ঝুঁকি নিতে অপারগ। বিশাল রহস্য উন্মোচন করার মতো মরিয়া হতে পিছপা হবে তারা; কিংবা সে রকমটা করতে দেখালেও পাঠকের কাছে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হবে না। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য বিশ্বাসযোগ্য একটি চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই হয়তো অকৃতদার হিসেবে দেখানোটাই শ্রেয়। আবার এমনও হতে পারে, এসব কারণের পাশাপাশি নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সব পাঠকের কাছে গোয়েন্দা চরিত্রগুলোকে আকর্ষণীয় আর স্বপ্নের মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য সহজ পথ বেছে নিয়েছেন তাদের¯স্রষ্টারা—রেখেছেন তাদের অকৃতদার করে। হয়তো ভবিষ্যতেও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। ব্যতিক্রম যে আসবে না তা নয়, তবে সেটা নিয়ম হয়ে উঠবে না সম্ভবত। তাতে ক্ষতি কী, স্বপ্নের কিছু চরিত্র থাকুক না সংসার নামের বন্ধন থেকে মুক্ত, অকৃতদার!!

Sort:  

Congratulations @r-n! You have completed some achievement on Steemit and have been rewarded with new badge(s) :

Award for the number of upvotes

Click on the badge to view your Board of Honor.
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word STOP

To support your work, I also upvoted your post!

Do you like SteemitBoard's project? Then Vote for its witness and get one more award!

Congratulations! This post has been upvoted from the communal account, @minnowsupport, by r-n from the Minnow Support Project. It's a witness project run by aggroed, ausbitbank, teamsteem, theprophet0, someguy123, neoxian, followbtcnews, and netuoso. The goal is to help Steemit grow by supporting Minnows. Please find us at the Peace, Abundance, and Liberty Network (PALnet) Discord Channel. It's a completely public and open space to all members of the Steemit community who voluntarily choose to be there.

If you would like to delegate to the Minnow Support Project you can do so by clicking on the following links: 50SP, 100SP, 250SP, 500SP, 1000SP, 5000SP.
Be sure to leave at least 50SP undelegated on your account.