সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: রয়টার্স
সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: রয়টার্স
কিছুদিন চুপচাপ ছিলেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তাতেই ছড়িয়ে পড়ল তাঁর মৃত্যুর আশঙ্কা! শেষে ছবি-ভিডিও দিয়ে সন্দেহের অবসান হলো। তাঁর এই চুপ থাকা নিয়েও আলোচনা কম নয়। সৌদি কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক কাজকর্মে প্রশ্ন উঠেছে, আসলে কী চান যুবরাজ? তিনি কি উদার, নাকি কট্টরপন্থীদের পক্ষে? কারণ, দুই পক্ষেই ধরপাকড় চালানো হচ্ছে। আবার সমাজসংস্কারের কর্মসূচিও চলছে!
২৪ জুন সৌদি আরবে বহু প্রতীক্ষিত একটি সামাজিক সংস্কারের চূড়ান্ত ঘোষণা আসার কথা। দেশটির সরকার বলেছে, নারীদের গাড়িচালনার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে সেদিন। এ নিয়ে বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ভোগ-এর আরব সংস্করণে এক সৌদি রাজকন্যাকে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে প্রচ্ছদও করা হয়েছে। কিন্তু গত মাস থেকেই এই সংস্কারের পক্ষে কাজ করা নারী আন্দোলনকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। শুধু তা-ই নয়, গ্রেপ্তারের পর চলছে আটক নারীদের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট করার প্রাণান্ত চেষ্টা, তা-ও আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে।
কট্টরপন্থীরাও সুবিধায় নেই। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান অঘোষিতভাবে শাসকরূপে অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকেই তাদের ওপর খড়্গ নেমে এসেছে। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে প্রকাশ্যে কথা বলার মতো অবস্থাতেও নেই কট্টর সালাফিরা। তাদের ক্রমে একঘরে করে ফেলেছেন যুবরাজ সালমান। অথচ একসময় সৌদি আরবে কট্টরপন্থীদের সমীহ করে চলত শাসকগোষ্ঠী।
দেশ আধুনিক করা হচ্ছে—এই একটি যুক্তি দেখিয়ে বাকি সব খারিজ করতে চাইছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। রক্ষণশীল দেশটিতে সিনেমা হল চালু, খেলার মাঠে নারীদের প্রবেশাধিকার বা রেসলিং প্রতিযোগিতার প্রদর্শনীর মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোকে দেখানো হচ্ছে, সৌদি আরবে পরিবর্তন আসছে কিন্তু তলে তলে চলছে দমন-পীড়ন। নিন্দুকেরা বলছেন, নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে চাইছেন যুবরাজ। এ জন্যই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে শাসিয়ে দিয়েছেন রাজপরিবারের প্রভাবশালী অন্য সদস্যদের। এখন দেশের ভেতরের বিভিন্ন পক্ষকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন তিনি। আর দেখনদারিতে বোঝাতে চাইছেন, সৌদি আরবে ঢের সামাজিক সংস্কার হচ্ছে!
সৌদি আরবে পরিবর্তন আসছে—দেখানো হলেও তলে তলে চলছে দমন-পীড়ন। ছবি: রয়টার্স
সৌদি আরবে পরিবর্তন আসছে—দেখানো হলেও তলেতলে চলছে দমন-পীড়ন। ছবি: রয়টার্স
নারীবাদীরা যুবরাজের কাছে ‘বিশ্বাসঘাতক’
সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মে মাস থেকে নারী ও মানবাধিকারের পক্ষে আন্দোলন করা সৌদি নাগরিকেরা হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। মোট ১৭ জন নারী ও মানবাধিকারকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার দেওয়া এবং পুরুষদের অভিভাবকত্ব-ব্যবস্থার অবসান চেয়ে আন্দোলন করছিলেন তাঁরা।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, আটক ব্যক্তিদের কয়েকজনকে মুক্তি দেওয়া হলেও বেশির ভাগের বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রতিশ্রুত সংস্কার কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে।
ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এর আগেও নারীবাদীদের ওপর দমন-নিপীড়ন চালিয়েছিল সৌদি কর্তৃপক্ষ। তবে এবারের ধরন আলাদা। কিছুদিন আগে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলার সময় আটক ব্যক্তিদের পরিচয় প্রকাশের ক্ষেত্রে বেশ গোপনীয়তা বজায় রেখেছিল সৌদি কর্তৃপক্ষ। তখন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা বলেছিলেন, আটক বা কারাদণ্ড পাওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। কিন্তু নারী অধিকারকর্মীদের বেলায় তা মানা হচ্ছে না। আটক নারীদের পুরো পরিচয় স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে এবং বলা হচ্ছে, তাঁরা দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। দেশের নিরাপত্তার জন্য তাঁরা হুমকি বলেও প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে সরকার-সমর্থিত পত্রিকায়।
সৌদি আরবে মানবাধিকার বিষয়ে পরামর্শক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন হালা আল-দোসারি। তিনি বলছেন, সরকারের এমন আচরণ আগে কখনো দেখা যায়নি। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সৌদি নারীদের গাড়িচালনার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিলেও তাতে সেখানকার নারী সমাজের আহামরি কোনো উন্নতি হবে না। কারণ এখনো দেশটিতে পুরুষদের অভিভাবকত্বের মধ্যেই জীবন কাটাতে হয় নারীদের। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নেই তাদের। এখন পুরুষ অভিভাবকত্ব-ব্যবস্থার অবসান চাচ্ছেন নারী অধিকারকর্মীরা। আর তাতেই সৌদি কর্তৃপক্ষের আপত্তি। এই দাবি যেন শক্তিশালী আন্দোলনে রূপ নিতে না পারে, সেই জন্যই রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ওয়াশিংটনে আরক গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের গবেষক ক্রিস্টিন স্মিথ দিওয়ান বলছেন, আসলে সমাজসংস্কারের সব কৃতিত্ব নিজের নামে লেখাতে চাইছেন যুবরাজ সালমান। কোনো আন্দোলনের কারণে তাঁর সরকার মাথা নোয়াচ্ছে—এটি মানতে নারাজ তিনি। একই সঙ্গে নিজেকে ‘সর্বেসর্বা শাসক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। আবার রক্ষণশীল কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতাদেরও তিনি কৌশলে হাতে রাখতে চাইছেন। এই ধরপাকড় করে তাদের প্রতি যুবরাজের বার্তা, ‘দেখুন, আমি নারী অধিকারকর্মীদেরও ছাড়ছি না।’
সালাফিরাও বিপদে
সৌদি আরবে বাদশাহি পরিবারের পরে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন সালাফিরা। এখন তাদের কণ্ঠরোধ করেছেন যুবরাজ। জনপ্রিয় সালাফি ধর্মীয় নেতাদের জেলে পোরা হয়েছে। তবে যেসব ধর্মীয় নেতারা কট্টরপন্থী নন এবং যুবরাজের সংস্কার কার্যক্রমের বিরোধিতা করছেন না, তাঁদের অবস্থা পোয়া বারো।
সালাফিরা ইসলামি আইনের কঠোর প্রয়োগের কথা বলে থাকেন। রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোনো স্থান তাদের কাছে নেই। অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকেও সমর্থন করেন সালাফিরা। নারী-পুরুষকেও সমান দৃষ্টিতে দেখেন না তাঁরা।
সংস্কারের পক্ষে কাজ করা নারী আন্দোলনকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। ছবি: রয়টার্স
সংস্কারের পক্ষে কাজ করা নারী আন্দোলনকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। ছবি: রয়টার্স
কিছুদিন আগেই সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যুবরাজ বিন সালমান বলেছিলেন, নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই, সবাই সমান। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যুবরাজের সঙ্গে সালাফিদের দ্বন্দ্ব কোথায়। নিজের সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সালাফিদের ‘রাজনৈতিক শত্রু’ বিবেচনা করেই দমন করছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
কিং ফয়সাল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ সৌদি রাজকীয় পরিবার কর্তৃপক্ষ পরিচালিত একটি সংস্থা। এর মহাসচিব সৌদ আল-সারহান সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে অতীতে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক ইসলামের সব সংগঠনকে ভেঙে ফেলার একটি স্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন শাসকেরা।’
ওয়াশিংটন পোস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সৌদি আরবে সালাফিদের সংখ্যা ১ থেকে ১০ লাখের মতো। সিনেমা হল খোলা বা কনসার্ট আয়োজনের সরকারি সিদ্ধান্তে তারা ক্ষুব্ধ। তাদের মতে, এতে করে ইসলামের পথ থেকে সরে যাবে সৌদি আরব। কিন্তু সরকারের কঠোর শাসনে কিছু বলার মতো অবস্থা নেই। মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
কী চান যুবরাজ?
অবস্থা যেমন দাঁড়িয়েছে, তাতে বলা যায়, নিজের বিরুদ্ধে একজনকেও দাঁড়াতে দিতে চান না যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। নিজের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাকেই ছেঁটে ফেলবেন তিনি। বিশেষ করে কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তিনি টিকতে দেবেন না।
ইকোনমিস্ট বলছে, এসসিএল গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যুবরাজ সালমানকে সলাপরামর্শ দিচ্ছে। এই ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হলো কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা, যা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত। এসসিএল গ্রুপ একটি রাজনৈতিক তথ্য প্রতিষ্ঠান। সৌদি আরবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার শুরুর আগ থেকেই যুবরাজকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে এসসিএল। মূলত সৌদি বাদশাহর রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পরামর্শ দিচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান।
রাজদণ্ডের ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর থেকেই যুবরাজ ধীরে ধীরে নিরাপত্তা বাহিনী, বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সংবাদমাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছেন। ফলে সৌদি আরবের ভেতরে প্রতিবাদ করার মতো কোনো পক্ষ অবশিষ্ট নেই। শুধু অতিরক্ষণশীল কট্টরপন্থী বা মানবাধিকারকর্মী নয়, সমাজসংস্কারের পক্ষে থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও কারাবন্দী করা হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাঁশের চেয়ে যেন কঞ্চি দড় না হয়, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। অর্থাৎ সৌদি যুবরাজকে অতিক্রম করতে পারবে না কেউ!
ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, সৌদি আরবের মূল জনগণের ৬০ শতাংশই তরুণ। আর তাদের ওপর অতিরক্ষণশীলদের প্রভাব খুবই কম। তাই এই কট্টরপন্থী সালাফিদের আর পাত্তা দিতে রাজি নন যুবরাজ। আর উদারপন্থীদেরও রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করতে দিতে চান না তিনি। কারণ, এতে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি শক্তি দাঁড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা আছে।
বেশ হিসাব-নিকাশ করেই মাঠে নেমেছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জনের পথে অনেক দূর এগিয়েও গেছেন তিনি। অবস্থা যেমন তাতে বলাই যায়, আরেক সর্বময় শাসকের অধীনে যেতে হচ্ছে সৌদি নাগরিকদের। আর তার শাসনকাল যে দীর্ঘ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
Hi! I am a robot. I just upvoted you! I found similar content that readers might be interested in:
https://www.jcpenney.com/