প্রিয়,
পাঠকগণ
আশাকরি আপনারা সবাই ভালো আছেন।
আজকে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো আমার এক বন্ধুর কথা।আমার কিছুদিন আগের লেখা একটি পোস্টে আমি বলেছিলাম,বুঝতে শেখার পর থেকে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে কষ্ট দেইনি।তবে আমার জন্য কেউ কষ্ট পাচ্ছিল জেনেও আমি তাকে মিথ্যে কথা বলে,তার কষ্ট কম করিনি।আজ তার কথাই আপনাদের বলবো।
প্রথমেই বলি শেখর আমার বন্ধু,শুধুই বন্ধু।ছেলে মানেই তার সাথে আমার যে অন্য সম্পর্ক ছিল এমনটা কিন্তু নয়।আমাদের বন্ধুত্বের গল্প করতে হলে অনেকটা আগে থেকেই শুরু করতে হবে। আমি তখন বি এ ফার্স্ট ইয়ার পড়ি। আমার বান্ধবী তিয়ার সাথে বন্ধুত্ব ছিলো শেখরের। ক্লাস ইলেভেনে ওরা একসাথে ফিলোসফি পড়তে যেত।যেহেতু আমার ফিলোসফি ছিলনা তাই শেখরের সাথে কোনোদিন আলাপ হয়নি।
এরপর কলেজে ভর্তি হলাম আমরা।সেকশন আলাদা হয়ে গেলো। তিয়া আর শেখর একই সেকশন। তবে ক্লাস না থাকলে আমরা সবাই বসে আড্ডা দিতাম হয় ক্যান্টিনে অথবা কলেজ গার্ডেনে। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে শুরু হয় আমাদের কথাবার্তা।তারপর বন্ধুত্ব।
এরপর একসাথে আমরা হাবড়া টিউশন পড়তে যেতাম। একটু একটু করে বন্ধুত্বটা বেশ গভীর হয়ে ওঠে। একে অপরের বাড়িতেও যাতায়াত শুরু হয়।বিভিন্ন পুজো,অনুষ্ঠান সব কিছুতেই যাওয়া আসা হত।প্রসঙ্গত বলে রাখি শেখর যে শুধু আমাদের বাড়ি আসতো বা আমিই শুধু ওর বাড়ি যেতাম এমন নয়।আমাদের গ্রুপের সবাই সব জায়গায় একসাথেই যেতাম।সেটা কারোর বাড়ি পুজো হোক। বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে।
যতই গ্রুপে থাকা হোক দেখবেন কারো না কারো সাথে আপনার বন্ধুত্ব অনেকের থেকে বেশি হবে যে হবে আপনার best friend. আমার ক্ষেত্রে সেটা কখন যেন শেখর হয়ে গেলো। ওর সাথে আমার বন্ডিং একেবারেই আলাদা ছিল।ফোন আমার গলা শুনলে বা আমাকে সামনে দেখেই ও বুঝতে পারত আমার মণ খারাপ।
একদম অন্যরকম একটা ছেলে ছিল শেখর।যে কোনো সমস্যায় ওকে ডাকলেই ও চলে আসতো।এমনকি আমার মায়ের সাথে ওর সম্পর্ক দারুণ ছিলো।আমাদের বাড়ি গেলেই কাকিমা এটা খাবো কাকিমা ওটা দাও এইসব চলতেই থাকতো। মা ও ওকে বলতো দোকান থেকে এটা একটু এনে দিবি, ব্যস সে ছুটলো।
আমার মনে পড়ে প্রথম যেদিন শেখর কেঁদেছিল আমার সামনে।ওর জীবনের একটা ভীষণ গোপন কথা ও আমায় বলেছিল।ওর মাকে নিয়ে,আসলে ও অনেক পরে জানতে পেরেছিল যে যিনি ওর জন্মদাত্রী মা তিনি ও জন্মাবার কয়েকমাস বাদেই মারা যান। পড়ে ওর মাসির সাথে ওর বাবার বিয়ে দেওয়া হয়।বিশ্বাস করুন ওটা শুনে আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। খারাপ লাগছিল, কিন্তু কি বলবো কিছুক্ষণের জন্য বুঝতে পারিনি।
ও যেইবার মাধ্যমিক দিয়েছিল সেবার ও জানতে পেরেছিল। তবে কাকিমা কোনোদিন শেখরকে এতটুকুও মায়ের অভাব বুঝতে দেননি।শেখর যদি আড়াল থেকে না শুনত তাহলে হয়ত ও জানতেও পারত না কোনোদিন।আমারাও কোনোদিন বুঝতে পারিনি ওদের বাড়ীতে গিয়ে।
যাইহোক,এইভাবে আমাদের বন্ধুত্ব চলছিল।সমস্যা তখন থেকে শুরু হলো যখন শুভর সাথে আমার সম্পর্ক শুরু হলো। আমার best friend হিসাবে আমি শেখরকেও জানলাম পুরো ঘটনা। ও ব্যাপারটা শুনে কিছুই বলেনি। কিন্তু আমার কোথাও একটু অন্যরকম লাগলো ওর রিয়াকশনটা।
পরে জানতে পারি ও আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিল।একদিন সামনাসামনি কথা বলি ওর সাথে, ওকে আমি বুঝিয়ে বলি আমার অনুভূতির কথা। আমি বরাবর ওকে বন্ধু ভেবে এসেছি। আর ওর দিক থেকে কখন বিষয়টি এগিয়েছে আমি বুঝতে পারিনি। এমনকি ও নিজেও বুঝতে পারেনি যতক্ষণ না শুভ এসেছে আমার জীবনে। সেই প্রথমবার আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল। তবে ভুলবোঝাবুঝি আমাদের মধ্যে কোনোদিন হয়নি।
আমি কোনোদিন ওকে অন্য চোখে দেখিনি, তাই সেদিন ও সেটা সম্ভব ছিলনা। আর এটা সবথেকে ভালো শেখর নিজেই জানত। সেই কারনেই ও কোনোদিন আমায় প্রশ্ন করেনি।আমার কাছে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা সম্পর্ক। তখনও ছিলো আর এখনও আছে। আমি শেখর কে আজও মিস করি,আমার সেই best friend কে মিস করি।
তবে হ্যাঁ একটা সময়ের পর আমি দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছি।কারণ আমার উপস্থিতি ওকে শুধু কষ্ট দিতে পারত। আমি কোনোভাবেই ওর সাথে অন্য সম্পর্কে জড়াতে পারতাম না।এরপর ও পলিটেকনিক পড়তে বর্ধমান চলে যায়।চাকরি করতে শুরু করে, আমারও বিয়ে হয়ে যায়।আমার বিয়ের পর ও এক দুবার ফোন করেছিল।প্রথমবার এটা জানতে আমি সুখী আছি কিনা? আর দ্বিতীয় বার নিজের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে।আর ওর মেয়ে হওয়ার পর।
হ্যাঁ প্রায় দুবছরের একটা ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে আছে ওর। ভালো আছে ওরা। ওর ভালো থাকাটা কাম্য ছিল আমার সবসময়। ওর মেয়ে হয়েছে শুনেই আমি ওকে বলেছিলাম, তোর মা ফিরে এসেছে তোর কাছে তোর মেয়ে হয়ে,কথাটা শুনে ও বলল -" জানিস,যেদিন আমার মেয়ে হয়েছে আমি সেদিনই ভেবেছি তুই যখন জানবি, তুই এই কথাটাই বলবি"
আমি অবাক হলাম। আজও এতটা বুঝিস আমায়। আমি কি বলবো সেটা আজও তোর জানা? এটাই বোধহয় বন্ধুত্বের ভালোবাসার জোর। আমি শেখর কে ভালোবাসি আমার বন্ধু হিসাবে। আজ হয়ত যোগাযোগ তেমন হয়না।নিজের নিজের সম্পর্ক গুলো নিয়ে নিজের জীবনে ব্যস্ত আমরা। তবুও একটা অদেখা সম্পর্ক থেকেই গেছে সবার অলক্ষ্যে।ভালো থাকিস শেখর।