লেভারকুজেনের রূপকথা — রূপকথার নায়ক শাবি আলোন্সো

in BDCommunity7 months ago (edited)

জার্মানির রাইন নদীর ঠিক পাশেই, ছোট্ট একটা শহর। কোলোন শহরের কাছেই এই শহরটা— লেভারকুজেন। শহরটা ছোট, ঢাকা শহরই এর চেয়ে প্রায় চারগুণ বড়। শহরটার নামই হয়েছে একজন কেমিস্টের নামে। প্রায় একশো বছরেরও আগে কার্ল লেভারকুজ নামের এক রসায়নবিদের নামে প্রতিষ্ঠিত হয় একটা ফ্যাক্টরি। সেখানে যারা কাজ করত তাদের বলা হতো ‘লেভারকুজেন’। পরে ‘বায়ার’ নামের আরেকটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি কিনে নেয় এই প্রতিষ্ঠান। এরপর এই ফ্যাক্টরির কর্মীরা মিলে একটি ক্লাব তৈরি করে, যার নাম হয় বায়ার লেভারকুজেন!

Source

ছোট এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহরের মানুষেরা, ক্লাবের ভক্তরা ভালোবাসেন ফুটবল। ক্লাব সাপোর্টারদের বলা হয় ‘ডাই ড্যাকসেলফ’ অর্থাৎ ফ্যাক্টরি ফুটবল ক্লাব (Die Werkself)। লেভারকুজেন সর্বশেষ মেজর ট্রফি, ডিএফভি পোকাল, জিতে ১৯৯৩ সালে। এর পর পাঁচবার বুন্দেসলিগায় রানার-আপ, তিনবার ডিএফভি পোকাল কাপে রানার-আপ, আর একবার সেই ঐতিহাসিক চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রানার-আপ! এ যেনো এক অভিশাপ! নাহলে এতো-এতোবার হৃদয় ভাঙে কীভাবে! এরই নাম কি ফুটবল?

জার্মানীতে লেভারকুজেন’কে মজা করে বলা হয় ‘নেভারকুজেন’! যার অর্থ বলা যায় সেকেন্ড কুজেন বা যারা কখনোই কিছু জিতে না। মূলত ২০০২ সালে যেখানে লেভারকুজেনের ট্রেবল জেতার কথা, সেখানে তারা জিততে পারেনি কিছুই! না টাইটেল, না ডিএভবি পোকাল, না আকাশের ঐ চাঁদ—চ্যাম্পিয়ন্স লিগ! ফুটবলপ্রিয় জার্মানীতে তাই সমর্থকদের বছরের পর বছর শুনতে হয়েছে অনেক টিটকারি, সইতে হয়েছে অনেক ট্রল!

image.png

Source

অনেক বড় এক কোম্পানি Bayer AG হচ্ছে লেভারকুজেনের মালিকপক্ষ। মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ও রেভনিউ এর দিক থেকে কোম্পানিটি জার্মানিতে ১৯তম। শহরটাও গড়ে উঠেছে এই কোম্পানির ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনকে ঘিরেই। তবে ফান্ডিং-এ তেমনটা খরুচে নয় ক্লাব। না কিনতে পারে দামি খেলোয়াড়, না দিতে পারে তারকারদের ভালো বেতন। ফলশ্রুতিতে বিগত বছরগুলোতে ক্লাব থেকে চলে যায় মাইকেল বালাক, লুসিও, জে-রবার্তো, লেনো, কাই হ্যাভের্টজ, আর্তুরো ভিদাল, ডিমিটার বার্বাটোভ, মুসা দিয়াবি’র মতো অনেক অনেক তারকা ফুটবলার। কেউকেউ যোগ দেয় রাইভাল দলগুলোতেও, এ যেনো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

এখন ফিরে যাচ্ছি ১৯৮১ সালের দিকে। সেইবছর জন্ম নেন স্প্যানিশ তারকা ফুটবলার শাবি আলোন্সো। সেবছরই রিয়াল সোসিয়াদাদ টানা দ্বিতীয়বারের মতো লা-লিগা টাইটেল জিতে! সেই দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন পেরিকো। স্প্যানিশ এই ফুটবলার আর কেউ না, শাবি আলোন্সোর বাবা, পেরিকো আলোন্সো। তিনি ছিলেন একজন স্প্যানিশ ফুটবলার ও কোচ। তাকে অনুসরণ করেই শাবি যোগ দেন রিয়াল সোসিদাদ-এ।

মজার ব্যাপার হলো, শৈশবে সেল বিচে খেলার সময় তার সাথে বন্ধুত্ব হয় আরেক ফুটবলারের। সে ফুটবলারও পরে যোগ দেন রিয়েল সোসিদাদ-এ, স্পেনের যুবদলে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে, আর এখন পাল্লা দিয়ে যাচ্ছেন সেরা ইয়াং ম্যানেজারের তকমা’র জন্য। হ্যাঁ, মিকেল আর্টেটার কথাই বলছি।

image.png

Source

ফুটবলার হিসেবে বলতে গেলে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বাদে সবই জিতেছেন শাবি। একটা বিশ্বকাপ, দুই-দুইটা ইউরো, দুইটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা, এফ-এ কাপ, কমুনিটি শিল্ড, কোপা ডেল’রে, তিনটা বুন্দেসলিগা, উয়েফা সুপার কাপসহ অনেক ট্রফি, খেতাব।

ফান ফ্যাক্টের জন্য, এবার আসা যাক ২০০২ সালে। তখন শাবি খেলেন রিয়েল সোসিয়েদাদ-এ। রিয়াল মাদ্রিদ যখন তৈরি করছে গ্যালাক্টিকো, তখন আবার ২০ বছর পর লা-লিগা জেতার খুব কাছাকাছি চলে আসে রিয়াল সোসিয়াদাদ। রিয়াল মাদ্রিদকেও তারা হারান ৪-২ গোলে। কিন্তু একদম তীরে এসে তরী ডোবালেন শাবি ও রিয়াল সোসিয়াদাদ। সেলতা আর ভ্যালেন্সিয়ার কাছে হেরে, শিরোপা জয়ের সুযোগ হারান শাবি’রা। ফলাফলে মাত্র দুই পয়েন্টের ব্যবধানে লা-লিগা টাইটেল জিতে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। ঠিক আগের মৌসুমে এভাবেই ট্রেবল জেতার কাছে এসে কিছুই পায়নি, লেভারকুজেন। তার প্রায় ২০ বছর পর লেভারকুজেনের কাছে নায়ক হয়ে আসলেন শাবি আলোন্সো।

Source

যেই টিমের সাথে শুরু করেছিলেন তার ফুটবলের ক্যারিয়ার, মোটাদাগে শাবি আলোন্সো’র কোচিং ক্যারিয়ার শুরু হয় সেই রিয়াল সোসিয়াদাদ-এর বি টিম নিয়ে, সেগুন্দা ডিভিশন বি-তে। কাজ শুরুর ২য় মৌসুমের মাঝেই এমন কী যেনো করলেন শাবি! রিয়াল সোসিয়েদাদ প্রোমোশন পেলো সেগুন্দা ডিভিশান এ’তে। ক্লাবের ইতিহাসে ৬০ বছরের ইতিহাসে জন্ম হয়নি এমন রূপকথার! তবে সেই প্রমোশন পাওয়া টিম হয়তো উপরের ডিভিশনের জন্য তৈরি ছিল না। পরের বছরই রেলেগেটেড হয়ে আবারও বি লিগে চলে আসে সানসে, অর্থাৎ রিয়াল সোসিয়াদাদ বি টিম। কোচিং এর দায়িত্ব ছেড়ে দেন শাবি। (রাউল গঞ্জালেজ, জাভি হার্নানদেজ, ভিক্টর ভালদেজ, ক্যাপডেভিয়া’র সাথে ২০১৮তে রিয়াল মাদ্রিদে, উয়েফা এলিট কোচিং কোর্স করেছিলেন শাবি, রিয়াল মাদ্রিদ অনুর্ধ ১৪ দলের সাথে)।

জোসে মোরিনহো অনেক আগেই অনুমান করেছিলেন যে শাবি ভালো কোচ হবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন শাবি’র বাবার কথা, বড়-বড় কোচের অধীনে খেলার কথা, আর ফুটবল মাঠে তার বিচক্ষণতার কথা। আসলেই, তিনি খেলেছেন জোসে মোরিনহো, পেপ গার্দিওলা, রাফায়েল বেনিতেজ, কার্লো এঞ্চেলোত্তি, ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি, ডেল বস্কের মতো সেরা-সেরা কিংবদন্তি কোচদের অধীনে। তবে শাবি বলেছিলেন তিনি বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন পেপ গার্দিওয়লার কাছ থেকেই।

শাবি আলোন্সো লেভারকুজেনে যোগ দেন অক্টোবর ২০২২ এ। তখন সিজনের ৮ ম্যাচ শেষে লেভারকুজেনের অবস্থান ছিল রেলেগেশন জোনে, ১৭ নাম্বারে (আঠারো দলের মাঝে)। ১৯৭৯ সালে বুন্দেসলিগায় প্রোমোশনের পর লেভারকুজেন কখনোই রেলিগেটেড হয়নি। এমন ভরাডুবির সময়ে দায়িত্ব নিয়ে দলকে নিয়ে আস্তেধীরে ভালো খেলতে শুরু করেন শাবি। ১৭ নাম্বার থেকে শেষমেশ ৬ নাম্বারে এসে ইতি টানেন মৌসুমের। ইউরোপা লিগে হার মানতে হয় তার গুরু জোসে মোরিনহোর দল রোমার কাছে।

সামারে বিক্রি করে দিতে হয় মুসা ডিয়াবি’কে। সেই টাকা থেকে শাবি নিয়ে আসেন অ্যালেক্স গ্রিমাল্ডো (ফ্রি), গ্রানিত জাকা, হফম্যান ও ভিক্টর বোনাফিসকে। বল পায়ে না থাকলে ৫-২-৩ ফরমেশনে আর বল দখলে থাকলে ৩-৪-৩ বা ৩-২-৫ ফরমেশনে, অসাধারণভাবে গেগ্যানপ্রেসিং ও টিকিটাকা মিলিয়ে সাথে লংবল আর কুইকপাস থেকে কাউন্টার নিয়ে, বিধ্বংসী এক ফুটবল খেলছে শাবির দল।

শাবির মাতৃভাষা স্প্যানিশ, এছাড়াও তিনি পারেন ইংলিশ ও জার্মান। বায়ার্ন মিউনিখে খেলতে এসে দ্রুতই রপ্ত করে ফেলেন জার্মান ভাষা। মাত্র ৪ মাসের মাঝেই জার্মান ভাষাতে ম্যাচ শেষে সাক্ষাৎকার দেন শাবি। মজার ছলে বলা হয় ফ্রানক রিবেরি এতোদিন জার্মানিতে থেকেও শাবির মতো জার্মান বলতে পারতেন না তখনও। আবার কোচ হিসেবে জার্মানিতে ফিরে এসেও শাবি প্রমাণ দেন তার ভাষাদক্ষতার। এমনিতে চাপা স্বভাবের হলেও অনুশীলনে তার মাথায় যা কাজ করে, তাই সরল মনে বলে দেন। যে খেলোয়াড়কে যে ভাষাতে বললে বুঝবে শাবি সেই ভাষাই ব্যবহার করেন। কোচিং এর ক্ষেত্রে তিনি পছন্দ করেন সহজ কমুনিকেশনে। (স্প্যানিশ ভাষা আসলে ব্রাজিলিয়ান, মেক্সিকান, আর্জেন্টাইন, পর্তুগিজ ভাষাসহ অনেক ভাষার কাছাকাছি। এছাড়াও কমকরে ২১টি দেশে ব্যবহৃত হয় স্প্যানিশ।)

image.png

Source

এই মৌসুমে ইউরোপের টপ-ডিভিশনের দলগুলোর মাঝে একমাত্র অপরাজিত দল শাবি’র লেভারকুজেন। ৩৮টা জয় ও পাচটা ড্র, টানা ৪৩ ম্যাচ ধরে অপরাজিত তারা৷ ওয়ের্ডার ব্রেমেনর সাথে ৫-০ গোলে জিতে গতকাল লেভারকুজেন ছিনিয়ে নিল বুন্দেসলিগার শিরোপা। অপরাজেয়, অপ্রতিরোধ্য চ্যাম্পিয়ন! এখনও বাকি আছে ডিএফভি পোকাল এর ফাইনাল, সাথে আছে ইউরোপা লিগ। ১১ বছর পর বায়ার্ন মিউনিখ বাদে লিগ জিতেছে অন্য কোনো দল। আর ৩১ বছররের কতো কান্না, কতো অপমান, কতো দীর্ঘশ্বাস, কতো অপেক্ষার পর একটা মেজর ট্রফি জিতলো রাইন নদীর তীরের ছোট এই শহরের ক্লাবটা! জিতলো নিজেদের প্রথম লিগ টাইটেল। হৃদয় ভাঙে যে ফুটবল, সেই ফুটবল মাঝে মাঝে এমন কিছু মুহূর্তও দেয়। এর জন্যই কি এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সমর্থন দিয়ে যাওয়া? মাঠে টিফো-পতাকা, ঘরে রিমোট হাতে নিয়ে বসে থাকা? একটা ম্যাচের জন্য সারা সপ্তাহ মন খারাপ করে থাকা? নাহ, এমন মাহেন্দ্রক্ষণ যদি নাও আসে, ফুটবলভক্তরা তবুও এভাবেই সমর্থন দিয়ে যাবেন। এটাই ফুটবল।

Sort:  

Congratulations @tajimkhan! You have completed the following achievement on the Hive blockchain And have been rewarded with New badge(s)

You distributed more than 44000 upvotes.
Your next target is to reach 45000 upvotes.

You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word STOP