আত্মকাহিনী

in BDCommunity3 years ago

image

pexels-photo-1034662.jpeg

বদ্ধ শহর থেকে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসের খোঁজে নিজের গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হবো, সাথে আরো কিছু বন্ধু বান্ধব আছে। বন্ধুরাও সাথে আছে যার কারণে আগে থেকেই একটি হাইচ গাড়ি ভাড়া করে রেখেছিলাম। সেই গাড়ির ড্রাইভার এর বয়স হবে আনুমানিক ৫৫ বছরের কাছাকাছি, গায়ের রং শ্যামলা , ভরাট মুখ , মুখভর্তি দাড়ি, দাড়ির ফাঁকে অসংখ্য গুঁটি বসন্তের দাগে ক্ষতবিক্ষত মুখ যেটা নজর কেড়েছিলো আমার। মানুষ হিসেবে দেখে বেশ কঠিন মনে হচ্ছিল, ভাবলেশহীন একজন মানুষ মনে হচ্ছিলো। বন্ধুরা মিলে গাড়িতে উঠে বসি। রওনা দিচ্ছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ফেলেছি। আজ শুক্রবার, জুমা’র নামাজের জন্য ড্রাইভার গাড়িটি রাস্তার পাশে থামালেন। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে তিনি তার পরনের প্যান্ট চেঞ্জ করে লুঙ্গি পড়লেন। আমি বললাম, লুঙ্গি কোথায় পেলেন? তিনি বললেন, নামাজের প্রয়োজনে সব সময় সাথে রাখি। কারন অপবিত্র পোষাকে তো নামাজ হয়না । এইজন্য আগে থেকেই ব্যাবস্থা করে রাখি।

-আপনি কি নিয়মিত নামাজ পড়েন?
-নিয়মিত না হলেও, চেষ্টা করি।
-কিন্তু আমি দেখলাম আপনি ৪০কিমি পথেই আনুমানিক 10 টি সিগারেট খেয়ে ফেলেছেন। ধুমপান করেন যে এতো?
-আগে আরো অনেক বেশি খেতাম, এখন ছাড়ার চেষ্টা করছি।
-আপনার কী মনে হয়, এই বদ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারবেন?’
-এর আগে এর থেকেও বড় নেশা ছিল , সেই গুলো করতে পেরেছি, এটাও পারবো ইনশাআল্লাহ।

-কী কী নেশা ছিল আপনার?
-মদ, গাজা, ভাঙ, চরস, যা আছে দুনিয়াতে কোনটাই বাদ পরেনি।।
-তাহলে অনেক মানুষই বলে যে নেশা একবার হলে আর কখনো ছাড়া যায় না। এই কথাটা কি সত্য?
-পুরোপুরি না হলেও, কথাটি আংশিক সত্য।
-এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
-আসলে ব্যাপার হচ্ছে আপনি নিজের মন থেকে নেশাটা ছাড়তে চাচ্ছেন কিনা। বেশিরভাগ সময়ই আমরা নেশা ছাড়ার ভান করে থাকি অন্যদের কাছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো আমরা মন থেকে চাই না সেটা। আমরা যে, মন থেকে এটা ছাড়তে চাই না সেটা আমরা নিজেরাও জানি। কিন্তু মন থেকে চাইলে নেশা ছাড়া কোন বড় ব্যাপার না। তবে সেই জন্য কঠিন মনের মানুষ হতে হবে।
-আপনার কী ধারণা এই ব্যাপারে, আপনি কঠিন হৃদয়ের মানুষ?
-আমাকে দেখে কী মনে হয় আপনার?
-জ্বি, আপনি কঠিন মনের মানুষই মনে হয়েছে।
-জীবনে কোনদিন এই চোখে পানি পর্যন্ত আসে নি, গাড়ি চালাই আজ থেকে বাইশ বছর হয়েছে, মানুষের মৃত্যু, এক্সিডেন্টও এই জীবনে কম দেখিনি, মানুষের মগজ ছিটকিয়ে রাস্তায় পড়তে দেখেছি, তাও একফোটা বুক কাঁপে নাই আমার।

তার গল্প শেষ হয়নি, এটুক বলেই উনি নামাজে গেলো। আমি একটু সামনের দিকে হেঁটে গেলাম, মসজিদের পাশে ছোট একটি হোটেল থেকে সবাই একসাথে নাস্তা করলাম। সব কাজ শেষে আমরা আবারও গাড়িতে উঠে বসলাম। নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। রাত্রের আবহাওয়া টা আরো মনমুগ্ধকর হয়ে উঠছে। চারিপাশে শুনশান ফাঁকা রাস্তা, সাঁইসাঁই করে পেছনে চলে যাচ্ছে আবছায়া গাছগুলো, রাস্তার পাশে বন্ধ মুদির দোকান, বিশ্রামরত কুকুরের দল, হলুদ ল্যাম্পপোস্ট। পেছনের সিটের সহযাত্রি আমার দুজন বন্ধু ক্লান্তিতে নিদ্রামগ্ন। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলাম আর্ধখাওয়া চাঁদ। রাতের আঁধারে বইছে যেন সৃগ্ধ এক আবহাওয়া, যেটা মুগ্ধ করেছিল আমাকে। নীরবতা নিজের মধ্যে চেপে বসেছিল। আমি সেই আবহাওয়া, সেই অন্ধকারের জোৎস্না রাতের চাঁদের মধ্যে ডুবে আছি । ড্রাইভার হঠাৎ আমাকে বললেন, 'গান ছাড়লে আপনার কি কোন অসুবিধা রয়েছে? আমার সেই মুহূর্তে গান শোনার কোন ইচ্ছে না থাকলেও, আমি তাকে বললাম কোন অসুবিধা নেই।

তিনি তার মোবাইল ফোনে পুরনো দিনের গান প্লে করলেন।

চোখের নজর এমনি কইরা একদিন খইয়া যাবে, পোড়া মনে যা দেখেছি, তাই রইয়া যাবে’।

তার এমন গান শোনাতে আমি অবাক হই, তার এমন গান শোনার কথা না। কিন্তু তিনি প্রেম-ভালোবাসার গান শুনছিলেন। একের পর এক গান বেজে যাচ্ছিল তার মোবাইল ফোনে। বাংলা সিনেমার অসংখ্য পুরোনো দিনের গান বেজে চলছিল। বেশিরভাগ গানই এন্ড্রু কিশোর, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদীদের গাওয়া। আবার কিছু গান ছিল, কলকাতার বাংলা সিনেমার। এভাবে একের পর এক গান বেজে যাচ্ছে। জানিনা কেন জানি আমার আচমকা মনে হচ্ছিল, রাস্তার এই নীরবতা, রাতের স্নিগ্ধ আবহাওয়া এই সবকিছুই গানের প্রতিটা ছন্দের সাথে মিলে যাচ্ছে। গানের প্রতিটা সুর, ছন্দে আছে কোন এক রহস্য। গান শুনতে শুনতে আমারও কেমন একটা তন্দ্রা লেগে এলো। ততক্ষণে বিশ্বরোড পেরিয়ে নিজের প্রাণের গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি ।

ঐ মুহূর্তে তিনি কিছু একটা বলে উঠলেন। কিন্তু আমি ঘুম ঘুম চোখে কিছু বুঝতে পারিনি।

-আপনি কি আমাকে কিছু বলেছেন
-তিনি আবারও বললেন, 'প্রেমেরই নাম বেদনা, এই কথাটা কী সত্য?

মোবাইলে তখন গান বাজছে, ‘প্রেমেরই নাম বেদনা, সে কথা বুঝিনি আগে…’

তারপর বাজলো, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সে কথা তুমি যদি জানতে… এই হৃদয় খুলে যদি দেখানো যেতো, তুমি যে কে আমার তুমি মানতে…’।

আমি লোকটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম। রাতের অন্ধকারে ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলোয় দেখলাম তার চোখ জলজল করছে । তার চোখের কোণা গড়িয়ে জল ঝরে পড়ছে। আমি কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আমি হাত বাড়িয়ে তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলাম। তিনি রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে খানিকটা স্থির হয়ে বসে রইলেন। তারপর আচমকা তার ভাঙা-জড়ানো গলায় বললেন, ‘আজ চৌত্রিশ বছর, একটা সেকেন্ডের জন্য তাকে ভুলতে পারলাম না!’

তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোন ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না। শুধু অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবছিলাম এখন হয়তো আমার কিছু না বলাই উত্তম। তিনি বললেন, বিয়ে করলাম, বাপ হইলাম, নাতি-নাতনি হলো, কিন্তু সেই মানুষটাকে একটা মুহূর্তের জন্য আজও ভুলতে পারলাম না। এটা কোন কথা হলো বলেন? তাকে ভুলে যাওয়ার জন্য কত কিছুই না করলাম, বিড়ি-সিগারেট ধরলাম, মদ গাজা ধরলাম, কত কিছু করলাম, সেই সব কিছু আবার ছেড়েও দিলাম , কিন্তু এত কিছুর পরও তাকে ছাড়তে পারলাম না, এইটা কি কোন কথা হলো, বলেন?

মানুষটা আমার সামনে বসে কাঁদছেন। এই দৃশ্যটা আমার কাছে আশ্চর্য এবং খানিকটা যেন উদ্ভটও মনে হচ্ছিল। আমি ভাবতে লাগলাম অমন শক্ত কঠিন বৃদ্ধ একজন মানুষ, গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল ধরে বসে তিনি, বাইরে অসম্ভব সুন্দর রকমের চাঁদের আলোয়, রাস্তার পাশে হলুদাভ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় , তার চোখের জলের রঙ মিশিয়ে কী বিস্ময়কর! হয়তো সেই কান্নায় মিশে আছে আরও রঙ, হাজারো গল্প, জীবনের সকল চাওয়া পাওয়া এবং নিজের যৌবনকাল।

আমি তার দিকে কিছুটা কৌতূহলবশত তাকিয়ে তা পড়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না।

তিনি আচমকা আবারও বলতে শুরু করল, 'গায়ের রঙ ছিল হলুদ পাখির মতো, কিন্তু সে ছিল বন্ধুর বোন, আমায় কেন যে পছন্দ করতো কে জানে? কিন্তু বন্ধুর বোন মানে আমারও তো বোন, তাই না বলেন? সে আমায় কত বুঝিয়ে ছিল, কিন্তু আমি বুঝি নাই। কারণ আমি তাকে কখনো ওই চোখে দেখিনি। ‌কিন্তু সে যখন আমার উপর রাগ করে স্কুল জীবনেই বিয়ে করে ফেলল, তখন আমি বুঝতে পারলাম, তারপর আমি বুঝেছিলাম নিজেকে। এর আগে আমি বুঝতে পারিনি কিছু। সেইদিন থেকে সব বুঝতে পেরেছিলাম সেই বোঝা না এখন পর্যন্ত থামেনি। একটা সময় এটা নেশা হয়ে গেছে আমার কাছে। কষ্ট পাওয়া এখন নেশার মতো হয়ে আছে। এই কষ্টের নেশা ছাড়ার জন্য কত নেশাই না ধরলাম। কিন্তু এই নেশাটা আর ছাড়তে পারলাম না।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কিন্তু আপনি যে আমাকে বললেন, সব নেশাই ছাড়া যায়। আর সেটা ছাড়ার জন্য আপনার মত কঠিন মনের মানুষ হওয়া লাগে এটাই শুধু।

তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, আমি ভুল বলেছি।
পৃথিবীর সব নেশাই ছাড়া যায়, কিন্তু এই নেশা কখনো ছাড়া যায় না। আপনি যতই কঠিন হন না কেন, খুনি হন, সন্ত্রাস হন, কিন্তু তাও আপনি এই নেশা ছাড়তে পারবেননা। ভালোবাসার ব্যথা পাওয়ার নেশা ছাড়া যায় না। ছাড়া যায় না কেন জানেন?

-কেন?

-ওই যে বলেছিলাম না, ছাড়ার ভান করি শুধু, কিন্তু নিজের মনে এই নেশা ছাড়তে চায় না। দুনিয়ার মধ্যে সবচাইতে খারাপ নেশা হলো এটা। এর চাইতে খারাপ নেশা আর কোন কিছু নেই।

আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে । আমার চোখের সামনে এক অদ্ভুত মানুষ কাঁদছে। এক অদ্ভুত নেশাগ্রস্ত মানুষ তার নেশার জন্য কাঁদছেন। এই নেশা জগতের আর সকল নেশার চেয়ে তীব্র, ভয়ঙ্কর! কে জানে, এই চোখের জলও জগতের আর সকল চোখের জলের চেয়ে তীব্র, ভয়ঙ্কর নয় কী!!

Sort:  

সুন্দর লেখা