প্রথম চাকরির গল্প(পর্ব ১)

in BDCommunity4 years ago (edited)

received_200443194649900.jpeg
সময়টা ২০১২ সাল, মাত্র পাশ করে বের হয়েছি বুটেক্স থেকে। চাকুরির ইন্টারভিউ দিতে গেলাম গাজীপুর এর নতুন একটা ফেক্টরিতে,আর্গন ডেনিমস লিমিটেড। এ চাকুরি করার ইচ্ছা ছিল না আসলে। বন্ধুরা গেল ওদের সাথে আমিও গেলাম চাকুরির ভাইবা দিতে।

৪ জন গিয়েছিলাম কিন্তু আধাঘন্টা ইন্টারভিউ নেয়ার পর ফ্যাক্টরির এজিএম আমাকেই সিলেক্ট করলেন। স্যালারি ১৮,০০০ এবং ৬ মাস,পরে ইনক্রিমেন্ট সহ কনফারমেশন। হঠাৎ কি মনে করে রাজি হয়ে গেলাম। আগে থেকে ২ জন বন্ধু কর্মরত ছিল ঐখানে।
FB_IMG_1593929774684.jpg
2 musketeers in frame.

আমাদের ৩ জনকে নেয়া হয়েছিল নতুন একটা ফ্লোর পরিচালনার জন্য। আমাদের শেড এর ইনিচার্য ছিলেন আমাদের একই ভার্সিটির ৩ বছরের সিনিয়র এক বড় ভাই, সাইফুর ভাই।

সাইফুর ভাই খুব আমায়িক মানুষ ছিলেন। খুব নামাজি ও মিশুক। সাইফুর স্যার যত আমায়িক আমাদের ডিপার্টমেন্ট হেড এজিএম স্যার ছিলেন ততই কড়া। উনি ক্ষেপে গেলে ওনার হাত পা কাপাকাপি শুরু হত, সাথে কিছুটা তোতলামি। একবার উনি রেগে গিয়ে এক অপারেটর গালি দিয়ে বসেন। অপারেটর ৬ ফুট লম্বা চওড়া, এজিএম ছোটখাট মানুষ। অপারেটর এজিএম স্যারের দিকে তেড়ে যায় মারবে এমন অবস্থা। পারে আমি গিয়ে ওকে ধরে নিরস্ত্র করি। ওই ছেলেটা আমার শিফিটের অপারেটর ছিল এবং আমাকে খুব পছন্দ করত।

আমাদের বাসা ছিল ফ্যাক্টরি থেকে ২/৩ কিলোমিটার দুরে। ৩ টা শিফটে চলত ফ্যাক্টরি। সকাল ৬- দুপুর ২ টা (A shift), দুপুর ২- রাত ১০ টা (B shift) রাত ১০টা-সকাল ৬ টা(C shift)। আমরা ছিলাম উইভিং সেকশনে। যেখানে সুতা থেকে ডেনিম কাপড় তৈরি করা হয়। বড় বড় আধুনিক লুম এ কাপড় উৎপাদন হত।

স্বাস্থ্যকর শব্দের তীব্রতা ৬০ ডেসিবেল। আর সেখানে শব্দের তীব্রতা ছিল প্রায় ১২০ ডেসিবেল এর মত, প্রথম দিকে প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করত। B শিফট করে যখন রাত ১০ টায় বাসায় আসতাম, তখন ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করলে শো শো শব্দ শুনতাম।

তবে সবচেয়ে খারাপ লাগত C শিফটে। আমার এমনিতেই রাত জাগা অভ্যাস ছিল। কিন্তু বন্ধুদের সাথে আড্ডা, কার্ড খেলার জন্য রাত জাগা যে আলাদা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম চাকুরি করতে এসে। বিশেষ করে রাত দুইটার পর আমার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যেত শিফটের লোকজনকে জাগিয়ে রাখা। কারন অপারেটর ঘুমিয়ে গেলে ম্যাশিন বন্ধ হয়ে যাবে। যার সরাসরি ইম্প্যাক্ট পড়বে শিফটের প্রডাকশন এর উপর। পরের দিন সকালে শিফট ইনচার্জ হওয়ার কারনে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। রাতে আমার উপর কেউ থাকত না আমি চাইলে ঘুমাতে পারতাম কিছুক্ষন কিন্তু ২ বছরের চাকুরিজীবনে আমি C শিফটে একদিন ও ঘুমাইনি। কারন যে অপরাধ নিজে করা হয় সেই অপরাধের জন্য অন্য কাউকে আমি কিভাবে বলব। শিফটের লোকজন ঘুমিয়ে গেলে ডেকে জাগিয়ে তোলা ছিল রাতের শিফটে ২ টার পর আমার প্রধান দায়িত্ব।

মাঝে মধ্যে রাতে খুব মন খারাপ হত। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কি জীবন পার করছি। যেখানে সুযোগ ছিল কর্পোরেট জবে যাওয়ার, সেখানে এই অজো পাড়াগায়ে কামলার মত খাটতেছি।

রাতের শিফট শেষ করে যখন বাসার দিকে যেতাম সকালে রিকসা পাওয়া যেত না। বিশেষ করে শীতকালে প্রচন্ড কুয়াশা পড়ত।এর মধ্য দিয়ে হেটে গিয়ে জামাকাপড় ভিজে যেত কুয়াশায়। সারারাত ডিউটি করে চোখে ঘুম নিয়ে ২/ ৩ কিলোমিটার হেটে আসা ছিল আরেকটা অত্যাচার। প্রতিটা দিন মনে হত কাল থেকে চাকুরিটা ছেড়ে দিব।
Nilanjona-Jahan-Pic.webp(https://thedhakatimes.com/94269/a-foggy-winter-morning-2/)

তবে ফ্যাক্টরির বাইরে সময়টা খুব ভাল কাটিয়েছিলাম। আমরা ৩ শিফটের ৩ জন খুব ক্লোজ বন্ধু ছিলাম। তাছাড়া শিল্প এলাকা হওয়ায় আশেপাশের ফ্যাক্টরিগুলোতে ভার্সিটির বন্ধু আর বড় ভাইরা ছিল। অফ ডেতে জমিয়ে আড্ডা আর খাওয়া দাওয়া হত।

আমার বন্ধু শাহেদ রান্না করতে পছন্দ করত। যদিও ওর ধারনা ছিল ও খুব ভাল রাধুনি। কিন্তু আমরা কেউ ওর সাথে একমত ছিলাম না। অদ্ভুত অদ্ভুত ডিস রান্না করে হাজির হত। আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা গলধঃকরন করতে হত।

ছেড়ে দেব ছেড়ে দেব করতে করতে ২ বছর আর্গন ডেনিমে ছিলাম। পরে চট্টগ্রামে একটা শ্রিলংকান কোম্পানিতে চাকরি হওয়ায় আর্গন ছেড়ে দেই।

তবে সেই দিনগুলো মনে পড়লে আজো নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই। এখন আমাদের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির অস্থির সময় যাচ্ছে। বায়াররা অর্ডার ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফ্যাক্টরির মালিকগন ছটাই করছেন শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের। আশা করব এই সেক্টর আবার ঘুরে দাড়াবে। ভাল থাকুক সব শ্রমজীবী মানুষ।

Sort:  

আপনার জন্য শুভ কামনা রইলো ।

ধন্যবাদ আপনাকে।