কথাটা আমি প্রায়ই শুনি,সাধারণত ঘুমানোর আগে শুনি।কিন্তু কথাটা কে বলে তাকে দেখতে পাই না। এদিক-ওদিক তাকাই,আশপাশে খুজি,কোথাইও তাকে দেখা যায় না। মাঝে মাঝে মেঝেতে তার হাটার শব্দ শোনা যায়-খস খস...খস খস...।সে যে আমার চারপাশে চলাফেরা করে সেটা বুঝতে পারি,কেবল বুঝতে পারি না কে এভাবে হাটে,কে আমাকে এভাবে অদৃশ্যভাবে ঘিরে রাখতে অবরিত।
কিছুদিন পর বুঝতে পারি নিপাও কেমন যেন করে। রাত হলেই কেমন যেন পাল্টে যায় ও । ঘুমের মাঝে হাসতে থাকে কিন্তু হাসিটা কেমন যেন অন্যরকম মনে হয়,রহস্যময় হাসি।রাত হলে পাল্টে যায় আমাদের ছোট মেয়েটাও।হঠাৎ-হঠাৎ তা কাছে এক-একটা পুতুল চিলে আসে লাল-নীল পুতুল,ছোট -বড় পুতুল,কিন্তু কোথা থেকে আসে কেউ জানে না।
পাশের ফ্ল্যাটের মোর্শেদ সাহেব আর তার স্ত্রীর আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুও আমাদের এই বাসাটা।তারা নাকি রাত-বিরাতে কী দেখতে পান আমাদের বাসার বারান্দায় সারা রাত ভরে তারা তা দেখার চেষ্টা করেন।
সুমার মাধ্যমে আবশেষে আমার (আর্থাৎ রাহাতের) পরিচয় হায়াৎ রাস্তি নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে।আধাপাগল অথচ ভীষন সচেতন এই মানুষটা সব কিছুর সমাধান করে ফেলেন এক সময়। তারপরও আমি সেই কথাটা শুনতে পাই ।আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলা সেই কথাটা শুনে আমি প্রায়ই চিৎকার করে বলি-কে তুমি,কে তুমি? কেউ কোন উওর দেয় না।সারারাত নির্ঘুমে কেটে যায় আমার।
"এমন কিছু অশ্রু থাকে যা কখনও যায় না ঝরে
এমন কিছু ভালো লাগা থাকে যা কখনও যায় না মরে।
এমন কিছু ভালোবাসা থাকে যার কোন নেই শেষ
এমন কিছু অনল থাকে যা জ্বলে অনিমেষ
এমন কিছু স্বপ্ন থাকে যা কখনও হয় না পূরন
এমন কিছু আবেগ থাকে যার কোন নেই ধরন
এমন কিছু মানুষ থাকে যাকে কখনও যায় না ভোলা
এমন কিছু কথা থাকে যা কখনও যায় না বলা।"
খুব স্পষ্টভাবে কথাটা আবার শুনতে পেলাম আমি।একেবারে স্পষ্ট।মনে হলো কেউ একজন আমার কানের কাছে এসে বলেছে কথাটা ।বরাবরের মতো ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি -না ,কেউ নেই ,ফাকা।ঘরের ভেতর কেবল আমি ,একা।যদিও এ মহুর্তে নিপা আছে ,শুয়ে আছে আমার পাশে,ঘুমাচ্ছে ।কথাটা যে ও বলে নি তা ওর মৃদু নাক ডাকার শব্দ শুনেই বোঝা যাচ্ছে ।তাছাড়া গলার স্বরটা কোন মেয়েরও না,পুরুষেরও না,একেবারে একটা বাচ্চার গলা।তবে বাচ্চাটা মেয়ে না ছেলে,তা বোঝ যায় না।
ভালো করে নিপার দিকে তাকালাম আমি।ঘুমের তালে তালে ওর নাকের দু'পাশে অল্প অল্প কাপছে।আরো ভাল করে আমি ওর দিকে তাকালাম।সারা মুখ লালচে হয়ে গেছে ওর।ঠিক লালচে না,কেমন যেন গোলাপি একটা আভা ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত মুখটায় ।কী যে মায়াময় লাগছে! হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে আলতো করে ওর গাল ছুয়ে আমি বল্লাম,"নিপা ,ঘুমিয়োছ তুমি?
কিছু বলল না নিপা।কেবল আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে সেখানে নিজের হাতটা রাখল।আমিও ওর হাতটা সরিয়ে দিলাম।নিপা যখনই ঘুমাক না কেন যতক্ষণই ঘুমাক না কেন,গালে হাত দিয়ে ঘুমাবে।ব্যাপারটা ভাল লাগে না আমার ।মনে হয় ঘুমের মত আরামপ্রমদ একটা ব্যাপারের সময়্ও ও চিন্তা করছে, গভীর চিন্তা।
আমি গাঢ় গলায় আবার ডাক্লাম,নিপা।'
কোন উওর দিল না নিপা।আগের মতোই শুয়ে রইল।আমি এবার ওর মাথায় হাত রেখে বললাম ,নিপা ,একটু উঠবে?
নিপা উঠল না।চুপচাপ কিছুক্ষন বসে থেকে ঘরের লাইট্টা নিভিয়ে দিলাম আমি ।রাত অনেক হয়েছে,ঘুমানোর দরকার।বালিশ মাথায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটা আবার বলল,'তুমি আমাকে মেরে ফেলে, বাবা!'
কথাটা আগের চেয়েও স্পষ্ট শোনা গেল,এবং এতি স্পষ্ট শোনা গেল বিছানা থেকে ঝট করে উঠে বসে কিছুটা শব্দ করে বললাম,"কে?"
কেউ কোন উওর দিল না কিছু নিপার ঘুম ভেঙ্গে গেল।ও বেশ চমকে ওঠা গলায় বলল ,কী হয়েছে?''
নিপার একটা হাত চেপে ধরে আমি উদ্বিগ্ন গলায় বল্লাম,'তুমি কিছু শুনতে পেয়েছ?
'হ্যাঁ।' কাপা কাপা গলায় বলল নিপা।
কী?
ঐ যে তুমি 'কে' বললে,সেটা শুনতে পেয়েছি।'
ওটা না।আর অন্য কিছু শুনেছ? আর কি শুনবো? আমার দিকে ভাল করে তাকিয়ে নিপা বলল,আর কিছু বলছ নাকি তুমি?
'আমি না'।ঘরের চার পাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিপা ,তুমি না তো কে?ঘরের ভেতর আর কাউকে দখছি না'।তুমি তো দেখতে পাচ্ছো না,কিন্তু স্পষ্ট একজনের কথা বলা শুনেছি আমি।'ঘরের চার পাশটায় এবার আমি চোখ বুঝলাম।
কী কথা শুনেছ?শুনলাম-নিপার চোখের দিকে তাকালাম আমি,না থাক।'
নিপা কিছুটা জেদি গলায় বলল,থাকবে কেন?''পরে বলব।''এখন বললে অসুবিধা কী?
'কোন অসুবিধা নেই।' তো?'
নিপার একটা হাত চেপে ধরলাম আমি,'এখন বলতে ইচ্ছে করছে না,নিপা ।প্লিজ ,পরে শুনো।'
হেসে ফেলল নিপা।
[ উৎস ]লেখক -সুমন্ত আসলাম।
সবাইকে ধন্যবাদ