নানু মনি: আমাদের পরম আদরের আশ্রয়স্থল!

in BDCommunity3 years ago

IMG_20210910_192844.jpg

আমার পাশে এমুহুর্তে যিনি বসে আছেন, তিনি আমার নানু মনি। বয়স প্রায় সত্তোরের কাছাকাছি। বয়স যতই বেশি হোক না কেন, এখন পর্যন্ত তিনি আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের একমাত্র শেষ আশ্রয়স্থল। নিজের সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা না করে তিনি এত বছর বয়সে এসেও এখন পর্যন্ত নিজের চিন্তার বাইরে গিয়ে সারাক্ষণ অন্যদের নিয়ে চিন্তা করেন। সত্যি বলতে কী, নানা ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে আমার এই নানু মনি উনার নিজের পরিবারকে নিজের দুই হাতে এখন পর্যন্ত আগলে ধরে রেখেছেন।

আমরা ভাই বোন বা কাজিন যারা আছি, তাদের সবাইকে উনি উনার নিজের হাতেই পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন। যদিও উনার এই বিষয়ে আলাদা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা নেই। কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়াই যে তিনি এই কাজটা সুন্দর ও সাফল্যের সাথে করতে পেরেছিলেন, তার প্রমাণ তো আমরা সবাই আছিই।

আমাদের নানু মনির পায়ে একটু একটু সমস্যা আছে। তিনি সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না। ছোটবেলায় নাকি খুব দূষ্ট ও ডানপিটে ছিলেন তিনি। হুট হাট করে গাছে উঠে যেতেন, বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। যখন উনার বয়স ৮ কিংবা ৯, তখন একবার বড় একটা আম গাছে উঠেছিলেন আম পেরে কাঁচা আমের ভর্তা খাওয়ার জন্য। কিন্তু সেদিন হুট করেই গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পায়ের হাঁড় ভেঙ্গে ফেলেন তিনি।

উনার বাবা উনার পা ঠিক করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি সেসময় মুম্বাই পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন পা ঠিক করানোর জন্য। কিন্তু কোনো ভাবেই তা ঠিক করতে পারেন নি। ফলে তখন থেকে আজ পর্যন্ত উনাকে কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই হাঁটতে হয়েছে এতদিন ধরে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে ২০২০ সালে উনি আবার সেইম জায়গাতেই আঘাত পেয়েছিলেন। যে কারণে বর্তমানে উনাকে চলাফেরা করার জন্য হুইল চেয়ার ব্যাববার করতে হচ্ছে। তবে নিজের এত সমস্যা থাকার পরেও উনার আমাদের নিয়ে চিন্তার কোনো শেষ নাই। আমরা সবাই ভাল আছি কিনা, কোনো সমস্যা ফেইস করতেছি কিনা বা যাবতীয় যত চিন্তা, সবকিছু যেন আমাদের ঘিরেই।

IMG_20210910_192652.jpg

আমার সাথে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও কথা হয়। সারাদিন বাড়িতে একা থাকেন, কোনো কাজ থাকে না। তো কতক্ষণ আর একা একা কথা বলা সম্ভব? তাও থাকেন গ্রামের বাড়িতে। অথচ উনার ছেলে মেয়েরা সবাই একেক জন একেক জায়গায় থাকে। এজন্যই যে যখন সময় পায়, তখনই উনার সাথে ফোনে কথা বলে। আর উনিও হয়তো সারাক্ষণ মোবাইল নিয়েই বসে থাকেন কথা বলার জন্য।

যখন কলেজে পড়তাম, তখন কয়েক দিনের ছুটি পেলেই নানু বাড়িতে চলে যেতাম। আমাদের নানু বাড়িটা অনেক ফাঁকা। এদিকে তেমন কোনো মানুষ টানুষ নেই। তাই আমরা কাজিনরা যখনই যেতাম, উনি খুব খুশি হতেন। বৃদ্ধ বয়সেও নিজে রান্না করে আমাদের খাওয়াতেন। এখন তো আর হাঁটা চলা করতে পারেন না, তাই রান্না করেও খাওয়াতে পারেন না। এইটা নিয়ে অবশ্য উনার আফসোসের শেষ নেই। বার বার বিভিন্ন ভাবে উনার সেই আফসোস এবং আক্ষেপ আমাদের কাছে নানা ভাবেই প্রকাশ করেন।

মাঝে মাঝে অবশ্য উনি উনার ছেলে মেয়েদের বাসায়ও বেড়াতে যান। একেক জনের বাসায় একেক বার। তবে তিনি কোথাও গিয়ে মন বসাতে পারেন না। নিজের ভিটায় একা হলেও উনার কোনো আক্ষেপ নেই। এখানেই তিনি তার শেষ জীবন কাটাতে চান। আর উনি খুবই একরোখা মানুষ। নিজে যা ডিসিশন নিবেন, সেইটাই একমাত্র ঠিক। আর কেউ উনাকে উনার মত থেকে দূরে সরাতে পারবে না।

IMG_20210910_192751.jpg

নানুর সাথে এখন প্রতি সপ্তাহে কথা হলেও দেখা তেমন একটা হয় না। কয়েক মাস আছে কাজিনের বিয়েতে এটেন্ড করার জন্য গ্রামে গিয়েছিলাম। তখন বিয়ের প্রোগ্রামের এক ফাঁকে নানুর সাথেও কিছুক্ষণের জন্য দেখা করে এসেছিলাম। যদিও আমার নানু বাড়ি এবং দাদু বাড়ি পাশাপাশি দুটো গ্রাম। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে মিনিমাম এক ঘন্টার মতো তো লাগেই।

নানুর সাথে ছোটবেলা থেকেই আমাদের অনেক অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেসব স্মৃতিগুলো হয়তো লিখেও শেষ করা যাবে না। আমরা যখন বান্দরবান ছিলাম, তখন প্রতি শীতে অর্থাৎ বার্ষিক পরীক্ষার পর ঠিকই নানু বাড়িতে চলে যেতাম। দাদু বাড়িতে আমাদের তেমন একটা যাওয়া হতো না। কারণ আমার দাদা কিংবা দাদী, কেউই বেঁচে নেই।

যায় হোক, আমরা সারা বছর অপেক্ষা করতাম যে কবে শীত আসবে আর কবে নানু বাড়িতে যাবো। কারণ যতবারই নানু বাড়িতে যেতাম, নানু আমাদের জন্য ততবারেই নানা রকমের পিঠা তৈরি করে রাখতো। নানু এমনিতেই খুব কর্মঠ ছিল। একা একা আমাদের জন্য অনেক রকমের পিঠা কিভাবে বানাতো, তা আমি এখন কল্পনা করেও পাই না। তবে ম্যারা পিঠাটা সবচেয়ে বেশি বানাতো। কারণ এটা অনেক দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়। ম্যারা পিঠা অবশ্য একেক জায়গায় একেক নামে পরিচিত। অন্য এলাকায় কী নামে পরিচিত, তা আমার জানা নেই।

IMG_20210910_192725.jpg

তবে সবচেয়ে বেশি মজা হতো যখন সব কাজিনরা একসাথে হতাম। আমাদের কাজিনদের সংখ্যা অনেক। সবাই মিলে ১৭ জন আমরা। তো বুঝতেই পারছেন, সবাই একসাথে হলে নানু বাড়িটায় একদম উৎসবের আমেজ তৈরি হয়ে যেত। আর আমাদের সবাই মূলত নানুর টানেই একসাথে হতাম। তবে এখন আর সেই সুযোগ হয় না। বিশেষ কোনো অকেশন ছাড়া তো কারো সাথে দেখাই হয় না। আর নানুও অসুস্থ হয়ে গেছে। তাই সব মিলিয়ে পুরানো দিনগুলো হারিয়ে গেছে।

Sort:  

আপনার এই পোস্ট পড়ে আমারও নানুর কথা মনে পড়লো। নানুর সাথে আমার বন্ধুর মত সম্পর্ক। আগে কাজিনরা বাসাতে আসলে যে মজা হতো এখন আর সবার একসাথে হবার সুযোগ হয়না।আপনার নানুর জন্য অনেক অনেক দোয়া রইলো। ❤️