পুকুরগুলো নিস্তেজ হয়ে মরে পড়ে আছে৷ আগের মতো এখন আর ছোট ছোট বাচ্চারা গিয়ে সারাদিন ঝাপাঝাপি করে না। শেওলা জমে আছে পুরো পুকুর জুড়ে৷ কিছুদিন পর হয়তো এখানে আর কোনো পুকুরও থাকবে না৷ পুরো পুকুর জুড়ে মাটি ভরাট করে গড়ে উঠবে কোনো বিল্ডিং। এভাবেই একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের শৈশবের সব প্রিয় স্মৃতিগুলো।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আজ থেকে অনেক বছর আগের স্মৃতিগুলো। তখন সম্ভবত ক্লাস টুতে কিংবা থ্রিতে পড়ি। এই পুকুরটা তখন নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল। আমি, আমার ভাই এবং গ্রামের আরো কিছু ছেলে মিলিয়ে সারাদিন পুকুরে ঝাপাঝাপি করে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বী এসে আমাদের বকা দিয়ে পুকুর থেকে তুলে এনেছিল। আমরা নাকি ঝাপাঝাপি করে নতুন পুকুরের পানি নষ্টি করে ফেলছিলাম৷ অথচ সেই পুকুরে আজ কেউ গোসল করতে নামে না। ছোট ছোট বাচ্চারা সাঁতার কাটতে আসে না।
স্নিগ্ধ, সুন্দর গ্রামের সৌন্দর্যগুলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে৷ পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের শৈশবের স্মৃতিগুলোও। কয়েক বছর পর হয়তো সেসব স্মৃতিগুলোর অস্তিত্বও থাকবে না। আগামী প্রজন্মের মানুষেরা আমাদের স্মৃতিগুলোর কথা শুনে অবাক হবে। যেমনটা আমরা ইতহাসের বই পড়ার সময় সেই সময়কার কাহিনীগুলো জেনে অবাক হয়। এভাবেই ছুটে চলছে পৃথিবী এক অজানা গন্তব্যের দিকে। সামনে কী আসবে, জানি না৷ কিন্তু ফেলে আসা গল্পগুলোও বেশিদিন আমাদের মাঝে টিকে থাকে না।
কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ভাগ করা এই ছোট নদীটার এক পাশ কুমিল্লা জেলায় পড়েছে, এবং অন্যপাশটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাল। নদীর নামটা কী, তা অবশ্য আমি জানি না। তবে গ্রামে আসার সময় প্রতিবার এই নদীটা পার হয়েই আসতে হয়। বছরের অন্যান্য সময় নদীর পানি অনেক কম থাকে যেন এক প্রাচীন মৃত নদী। কিন্তু বর্ষাকালে নদীর চেহারা পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যায়। পানি একটু বেশি হলেই যেন নদীর দুই পার ভাসিয়ে নিয়ে যাবে৷ গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতেই নদীর পানির এই অবস্থা৷ আরো কিছুদিন বৃষ্টি হলে নদীর কী অবস্থা হবে, সেই কথা ভেবে হয়তো নদীর তীরবর্তী বাসিন্দাদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়তে পারে।
নদীর তীরে বিশাল বড় খেলার মাঠ। ছোটবেলার বেশিরভাগ স্মৃতিগুলো হারিয়ে গেলেও এই খেলার মাঠের স্মৃতিগুলো হারিয়ে যায় নি এখনো। দল বেঁধে নানা বয়সের ছেলেরা এখনো পুরো মাঠ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দলে দলে ভাগ হয়ে কেউ খেলছে ফুটবল, আবার কেউবা ক্রিকেট। আমাদের দেশে এখন ঘুরে ফিরে এই দুইটা খেলাই বেশি খেলা হয়। শীতকাল আসলে অবশ্য শুধু ব্যান্ডমিন্টন খেলা হয়। এর বাইরের বাকি যেসব খেলা আছে, সেগুলো কী এখন তেমন একটা চোখে পড়ে? একদমই না।
হাডুডু, গোল্লাছুট, সাতচারার মতো একদম দেশীয় খেলাগুলো এখন আর কাউকে খেলতে দেখা যায় না। ব্যাপারটা অদ্ভুত না? আমি নিজেও তো লাস্ট কবে এইসব খেলা খেলেছি, মনে হয়। হুট করে এইসব খেলাগুলো হারিয়ে গেল কেন? এখনকার মানুষেরা এসব পছন্দ করে না? নাকি মোবাইল, কম্পিউটার আর অনলাইনের কারণে মানুষের আর সময় হয়ে উঠে না এগুলো খেলার জন্য? ক্রিকেট আর ফুটবলটা অবশ্য টিকে আছে। এইটাও বা কম কী?
যায় হোক, গ্রামের পথে প্রান্তরে কিংবা আনাচে কানাচে ঘুরাঘুরি শেষ করে জলদি আবার ফিরে যাচ্ছি ছুটি শেষে সেই ইট পাথরের নগরীতে৷ গ্রামের যতই পরিবর্তন হোক না কেন, অন্তত বিশুদ্ধ একটা বাতাস পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় ঝিঁঝি পোকা দেখা যায়, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া যায়৷ কিন্তু শহরে তো এসবের কোনোটাই নেই। তাই হুট করে গ্রামে আসলে এইসব দৃশ্য হুট করে চোখে পড়লে খুব ভাল লাগে। অন্যরকম কিছু অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ব্যাপারটা অদ্ভুত, তাই না?
ইদের ছুটি শেষ৷ এখন আবার সেই বিরক্তিকর গতানুগতিক জীবনে ফেরার পালা। সুযোগ পেলে আবার হয়তো পালিয়ে গ্রামে ফিরে আসবো৷ দুই একদিনের জন্য এসে মনটাকে শান্ত করে নিয়ে ফিরব। সে পর্যন্ত গ্রামের থেকে যাওয়া স্মৃতিগুলো একটু একটু করে মনের গহীনে পুষে যাবো...
গোমতী নদী মনে হয় !