বাইরে তখন তুফান চলছে। বান্দরবান থেকে বন্ধুর ফোন,
-কই তুই?
-বাসাতেই।
-আন্টি তোর সাথে?
-হ্যাঁ।
-যা বলতেছি চুপ করে শোন। মুখে কিছু বলার দরকার নাই। বান্দরবানে বাস একটা এক্সিডেন্ট হইছে। ধারনা করতেছি আংকেল ঐটাতে ছিল। এখনোও শিওর না। তুই আপাতত কাউকে কিছু বলিস না।
মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। লাইন কেটে বাবার নম্বরে কল দিলাম, কিন্তু সংযোগ হয় না। উনার অফিসে কল দিলাম, উনারাও নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত বাবার বন্ধু একজন নিশ্চিত করলেন বিষয়টা। ওখানে আসলে বাস এক্সিডেন্ট হয় নি, রাস্তার পাশের পাহাড় ধ্বস হয়েছে। অনেকেই নিখোঁজ হয়ে আছে। নিখোঁজের তালিকায় বাবাও আছেন। এদিকে আম্মু একটু পর পর আমার রুমে এসে উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন। উনি কিছু বুঝতে পারছিলেন না। আর উনাকে কিছু বলার মতো শক্তি, সাহস কোনটাই ছিল না আমার। ব্যাগ একটা কাঁধে নিয়ে কিছু না বলেই তুফানের মাঝে রওয়ানা দিয়েছিলাম বান্দরবানের উদ্দেশ্যে।
কুমিল্লা থেকে বান্দরবানের দূরত্বটা কম না। গাড়িতে বসে কান্না চাপার চেষ্টা করছিলাম শুধু। আর একটু পর পর ধ্বসের স্পট থেকে একেকজনকে উদ্ধারের খবর আসছিল। প্রতিবার কল আসছিল আর আমি ভাবছি এইবার বুঝি বাবার উদ্ধার হবার কথা জানাবে।
এদিকে ঘন্টা তিনেক পার হয়ে গেলেও আম্মু কিছুই জানতে পারে নি। দুপুরের সব কাজ শেষ করে টিভি খুলে বান্দরবানের পাহাড় ধ্বসের খবর দেখে বাবাকে কল দেয়। সংযোগ না পেয়ে আমাকে কল দিল। সেমুহুর্তে আর কান্না চাপিয়ে রাখা সম্ভব হল না। হাওমাও করে কান্না শুরু করে দিয়েছিলাম...
বিকালের দিকে সেনাবাহিনী উদ্ধার কাজ স্থগিত করে দেয়। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারনে নাকি খাঁদে নামা যাচ্ছে না। সকালে আবার শুরু করবে। শুধু মনে হচ্ছিল বাবা হয়তো কোথাও আটকা পড়ে আছে। সারারাত পাহাড়ের খাদের কোন এক অংশে অপেক্ষা করছে উদ্ধার হবার আশায়। সকাল হলেই উনি ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে...
এরপরের নয়দিন ধরে টানা চলল উদ্ধার অভিযান। জীবিত আর কাউকে উদ্ধার করা যায় নি। পাহাড়ের নিচের ঝিরি দিয়ে একেকজনের লাশ একেক দিকে চলে গিয়েছিল। একজনের লাশ তো প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। এদিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে লাশ উদ্ধার হবার নিউজ আসতে থাকে। একেকটা নিউজ আসে আর সেনাবাহিনীর লোক ছবি দেখে শনাক্ত করার জন্য আমাকে ডাকে। যতবার ডাক দেয়, ততোবার পায়ে কাঁপন শুরু হয়ে যায়। পৃথিবীতে এর চেয়েও অসহায় মুহুর্ত আর হতে পারে বলে আমার জানা নেই।
৯ দিন পর বাবার লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। শেষবার দেখার সুযোগ পর্যন্ত হয় নি। এম্বুলেন্সে করে রাতের বেলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলাম। সারারাত বাবার কফিনের পাশে ছিলাম। জীবনে বহুবার বাবার পাশে বসে এই রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া করেছি। অথচ কে জানতো, আমাদের শেষ জার্নি টা এমন হবে...
আহা 😢
হৃদয় বিদারক 😢
যার বাবা নাই সে বুঝে বাবা হাড়ানোর যন্ত্রণা। আল্লাহ্ বাবা কে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।
আমিন
গল্প কিনা জানিনা! কিন্তু আমি এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম নাহ
মানুষের জীবনে হুয় করে এমন অনেক কিছুই ঘটে, যা হয়তো মেনে নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু দিন শেষে বাস্তবতার কাছে সবাই অসহায়।