চা বাগানের উপর ফ্যাসিনেশন আমাদের কম বেশি প্রায় সবারই আছে। একদম সমান ভাবে সুন্দর করে ছাঁটা বামুন আকৃতির সবুজ গাছগুলা দেখে সবারই চোখ জুড়ায় যায়! চা বাগানের পাশ দিয়ে গেলে মনে হয় এক দমে ছুটে গাছগুলার মধ্যে দিয়ে টিলার মাঝে হারায় যাই! কোন একটা টি স্টেটে ঠান্ডামাখা এক রাত থাকার আফসোস সবসময়ই ছিল কিন্তু সেই সুযোগ যে আল্লাহ একদিন সত্যিই পূরণ করে দিবে এটা কে জানতো?!
কথা বলছি সিলেটের হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া টি স্টেট থেকে! এটা মূলত সরকারি টি এস্টেট। ন্যাশনাল টি কোম্পানির চা এর বড় একটা অংশ আসে এখান থেকে। বিশাল জায়গা নিয়ে এই চা বাগান রাজত্ব করে চলছে। আমরা গিয়েছিলাম এ মাসে শীতের শুরুর দিকে। হালকা হালকা ঠান্ডা কেবল পড়া শুরু হয়েছে। টি স্টেটের ম্যানেজার বলছিল আশপাশ ঘুরে মজা লাগবে যদি একদম ভোর বেলা উঠে বেড়িয়ে পড়া যায়। আমরা এই কথা শুনে ঘুম থেকে উঠে পরেছিলাম ৬ টার আগেই! উঠে আমাদের বাংলোর সামনের অংশ দেখে চোখ জুড়ায় গেল! শীতের সকাল তো এমনিতেই সুন্দর। কিন্তু এখানকার ভোরের সৌন্দর্য অপার্থিব! পুরো মনে হবে যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছি!
পুরো বাংলোর চারপাশ মেঘের মতন কুয়াশা দিয়ে ঢাকা। সাথে হালকা চাদর গায়ে দেয়ার মতন শীত। আশপাশে শব্দ বলতে শুধু ঝিঁঝিঁপোকা, ঘুঘু আর পাতার আওয়াজ। সামনের লনে সুন্দর করে ছাঁটা ঘাসে পড়ে আছে রাতের জমানো শিশির। দেখেই নেমে গেলাম পায়ে শিশির মাখাতে। লোভ একটু বেশিই ছিল কারণ ঢাকার মাটিতে শিশির অথবা ঘাস কোনটারই দেখা মেলে না! আমাদের পাঁচজনের গ্যাং রেডি হতে হতে কিছুক্ষণ হেঁটে নিলাম এই ভেজা ঘাসে।
তেলিয়াপাড়া টি এস্টের সৌন্দর্যটা এমন আর এত কিছু দেখার আছে যে সিলেটের আশপাশ আর দেখতে যাবার প্রয়োজন হয় না। বাংলো থেকে বের হয়েই বিশাল এক পুকুর পরে। সকালের কেবল উঠা সূর্যের আলো তখন পানিতে পড়ছে। পুরো পুকুরপাড় ঘিরে বড় বড় সব গাছ। দেখে মনে হচ্ছিল এখানেই বাকিটা সময় কাটায় দেয়া যায়!
এরপর কিছুদূর হেঁটে চলে আসি একদম চা বাগানের মাঝে! নরম রোদের আলো তখন চা পাতার শিশিরের উপর পড়ছে। হালকা কুয়াশার জন্য চা বাগানের বেশি দূর পর্যন্ত দেখা যায় না। চা গাছের ফাঁকে ফাঁকে সাদা সাদা ফুল ছিল। পরে শুনলাম আগাছা গাছ বেয়ে উঠছে বলে এই ফুল। মনে মনে ভাবলাম পরগাছার ফুলও কত সুন্দর হয়!
চা বাগান ধরে রাস্তাটা ছিল মেঠো পথ। রাস্তায় কিছুদূর পর পর বিশাল বিশাল কেঁচো দেখা যাচ্ছিল। কিছু আবার সাইকেলের চাকায় মাড়ানো। সাথে দুইপাশে কেঁচোর তৈরি করা মাটির ডিবি। প্রকৃতির লাঙল হিসেবে ভালো কাজ করছিল!
চা বাগানের ফাঁকে ফাঁকে কড়া রোদ থেকে চা গাছকে ছায়া দিবে এমন গাছ লাগানো। যার মধ্যে বেশিরভাগই কড়ই।
কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি আগার আগার গাছের বিশাল বড় বাগান। এই টি স্টেটের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটা গাছের শুমারি করা আছে। গাছের গায়েই খোদাই করে নাম্বার লেখা। সেই সুবাদেই জানতে পারলাম প্রায় আড়াইশোর মতন আগার আগার গাছ আছে এই বাগানে। আমাদের ট্যুর গাইড আসিস্টেন্ট ম্যানেজার বললো আগার আগারের এমন বাগান সামনেও আরও কয়েকটা আছে! ন্যাচারাল ভেজিটেবল জেলোটিন নামে খ্যাত এই আগার আগার পাউডার দিয়ে নানা রকম মিষ্টি জাতীয় খাবার বানানো যায়। এছাড়া কসমেটিকস, আর ফেব্রিকেও ব্যবহার করা হয়।
এরপর সামনে আগাতেই দেখলাম ছোট ছোট চা পাতার চারা করা আছে বিশাল জায়গা নিয়ে। মজার ব্যাপার হলো, চারা করা হচ্ছে একটা মাত্র চা পাতা দিয়ে! পাতার মাঝখানে একটু খানি চিড়ে মাটিতে রেখে দেয়া হয়। সেই পাতারই গোড়া থেকে নতুন গাছ উঠে। কিন্তু আপনি চাইলে এই পাতা বাসায় এনে এভাবে গাছ বানাতে পারবেন না, পার্থক্যটা হলো মাটিতে। চারার জন্য স্পেশাল ভাবে মাটি তৈরি করা হয়।
এই চারা যখন টডলার পর্যায়ে পৌঁছাবে তখন তাদের নিয়ে আরেক জায়গায় প্ল্যান্টেশন করা হবে, আর প্রাপ্ত বয়স্ক হলে ওখান থেকে উঠিয়ে পারমানেন্টলি বড় গাছের জায়গায় লাগানো হবে।
চা বাগানের যে জিনিসটা খারাপ লেগেছে তা হলো পোকা মাকড় না হওয়ার জন্য ওরা যে কিটনাশক ব্যবহার করে সেটার কারণে জীব জগতের খাদ্য চক্রটা নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষতিকর পোকার সাথে আরও অনেক কিট আর আগাছা মারা পড়ে। এখন চা গাছের গুরুত্ব বেশি থাকায় এসব দিক দেখার সুযোগ নাই।
তেলিয়াপাড়া টি স্টেস্ট ঐতিহাসিক ভাবেও বেশ বিখ্যাত। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা আর নতুন সরকার গঠনের পরিকল্পনা এখানেই প্রথম শুরু হয়। সেসব ডিটেইলস নিয়ে থাকবে পরের কোন একদিনের লেখায়! এত সুন্দর মিষ্টি সকাল কয়েকটা পেলেই সারা বছরের জন্য খোরাক হয়ে যায়! এই সকালের ভালো লাগা সামনের কয়েকমাস পজিটিভ এনার্জি দিবে এটাই আশা করি!