ক্লিওপেট্রা - রিভিউ

in BDCommunity7 months ago

ক্লিওপেট্রা শেষ করার পর অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। বইটা শেষ করার পর মনে হয়েছে এটা না পড়লেও খুব একটা ক্ষতি হতো না। এরপর প্রায় এক দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে বইটার রেশ থেকে পুরাপুরি বের হতে পারছি না। গল্প এমন কোন আহামরি কিছু না যেটা এতদিন পর্যন্ত কাউকে ধরে রাখতে পারে। আমার মনে হয় আসল জায়গা হচ্ছে হেনরি রাইডার হাগার্ডের কাহিনী বলার ধরণ। সে এত ইউনিক উপায়ে প্লটটা সাজিয়েছে যে কাহিনী কারোও কাছে ভাল লাগুক না লাগুক, এক টানে শেষ করবোই। হুমায়ূন আহমেদের ১০ক্স ভার্সন বলতে পারেন!

সেদিন ও খেয়াল করে বলল, আমার একটা অদ্ভুদ স্বভাব আছে। এক্ট্রিম ক্লাইমেস্কের বইও আমি আস্তে ধীরে শেষ করি, যেখানে ওর যেটা ভাল লাগে সেটা যত কাজের মধ্যেই থাকুক, একটানে শেষ করবে। আমার মতন এই বদ অভ্যাস হয়তো খুব কম মানুষের মধ্যেই আছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, এই ক্লিওপেট্রা পড়ার সময় আমি আমার স্বভাব ভুলে প্রায় একটানেই বইটা শেষ করেছি।

আমার কাছে যেই জিনিসটা অবাক লেগেছে গল্পের শুরুতেই বলে দিয়েছিল এখানে শেষ পরিনতি কি হবে। একদম সব জেনে পড়া শুরু করার পরেও কেন বইটা এভাবে আমাকে টানতে পেরেছে এর কারণটাই বের করতে পারছি না। একদম প্রেডিক্টেবল স্টোরি দিয়ে শুরু করে পাঠককে ধরে রাখা কিন্তু খুব সহজ কাজ না। আমার কাছে মনে হয়েছে এমন এন্ডিং আসলে কেন হলো এটা জানার আগ্রহ থেকেই কাহিনী জানার জন্য প্রবল উৎসাহ নিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়েছিলাম।

বুঝানোর জন্য কাহিনির শুরুর দিকটা একটু সংক্ষেপে বলি। বহু বছর পর চোরাকারবারিদের হাতে তিনটি মমি পরে। তারই মধ্যে একটি মমির ঢাকনা খুলে দেখা গেলো খুবই নির্মম ভাবে মেরে কোনমতে লাশটিকে মমি করা হয়েছে। সাথে তিনটি প্যাপিরাসের রোল। পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে বের হয়ে আসলো অবিশ্বাস্য একজনের জীবনী। যার নাম হলো হারমাচিস। ইনি নাকি রানী ক্লিওপেট্রার পুরহিত এবং উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, হারমাচিসের জন্মের সময়ই তার মা ভবিষ্যৎবানী করে গিয়েছিল যে সে এক সময় মিশরের প্রধান পুরহিত হবে। আর তার দায়িত্ব হবে রানী ক্লিওপেট্রাকে মেরে নিজে সিংহাসনে বসা।

কিন্তু মিশরের ফারাও হওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার না। তার বাবা এবং চাচার সহযোগিতায় কয়েক বছরের মধ্যে নানা বিষয়ের উপর বিশদ বিদ্যালাভ, যুদ্ধবিদ্যা, দেবদেবীদের উপর জ্ঞানলাভ করে সে হয়ে উঠে মিশরের শাসক হওয়ার জন্য যোগ্য এক পুরুষ।

কিন্তু শেষমেশ কি সে পেরেছিল ক্লিওপেট্রাকে খুন করতে? বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সুন্দরী, জ্ঞান, রূপ ও যোগ্যতায় যাকে এখন পর্যন্ত কারও সাথে তুলনা করা যায় না তাকে খুন করতে গিয়ে কি হারমিচাসের হাত কেঁপেছিল? সেকি পেরেছিল মিশরকে ভিনদেশী হাত থেকে রক্ষা করতে?

71RteIPUQqL._AC_UF1000,1000_QL80_.jpg

image

ভালোর দিক বলতে গেলে গল্প পড়তে গিয়ে সে সময়ের মিশরের সংস্কৃতি নিয়ে বেশ কিছু তথ্য জানতে পেরেছি। এছাড়া সেসময়ে রাজা রাণী কিভাবে চিন্তা ভাবনা করতো, কূটনৈতিক পরিকল্পনা কিভাবে করতো এসব নিয়েও বেশ গভীরে গিয়েছে লেখক।

যদিও কাহিনী ফিকশন হিসেবে লেখা, ইতিহাসের যেসব তথ্য এখানে দেয়া হয়েছে তা ফ্যাক্ট হিসেবে নেয়া যাবে না, তারপরেও ক্লিওপেট্রার আমলের শাসনতন্ত্র নিয়ে একটা সুন্দর ধারণা হয়েছে।

বইটা পড়তে গিয়ে একটা জিনিস যেটা আমার চোখে পড়েছিল তা হলো ওইসময়ে মিশরের লোকেরা কথায় কথায় দেবদেবীদের নামে শপথ নিতো। যেটা এখনকার দিনে সেরকম দেখা যায় না।

এখানে গল্পে প্রধান বিষয়বস্তু ছিল প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা ও রাজনীতি। বইটায় ক্লিওপেট্রার রূপের বর্ণনা এত চমৎকার ভাবে দিয়েছিল পড়ে মনে হচ্ছিল আসলেই যদি তাকে দেখতে পারতাম! কিন্তু তার কোন ছবি বা পেইন্টিং পাওয়া যায়নি। নেটে ঘেঁটে দেখলাম সেখানে কাল্পনিক চরিত্র হিসেবে তাকে দেখানো হয়েছে।

বর্ণনা অনুসারে আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো হোয়াইট ছিল, কিন্তু নেটফ্লিক্সে ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে নতুন যেই সিরিজ বানাচ্ছে সেখানে একজন ব্ল্যাককে কাস্টিং করেছে। পূর্বপুরুষ গ্রিক হওয়ায় তার কি নিগ্রো হওয়ার কোন সুযোগ ছিল? আমার কাছে তা মনে হয়নি। হয়তো এবারের লিটল মারমেইডে এরিয়েল যেকারণে ব্ল্যাক ছিল সেই কারণ হয়তো এখানেও নিয়ে এসেছে!

সব মিলায় ক্লিওপেট্রা আমার কাছে খারাপ লাগেনি। অনেকদিন পর একেবারেই অন্য ধাঁচের একটা বই পড়া হলো।

বইটা পড়ে একটা অদ্ভুত জিনিস মাথায় ঘুরছিল। একাকীত্বের কি কোন সংজ্ঞা হয়? আমার কাছে মনে হয় একেক জনের কাছে একাকীত্ব একেক রকম। কারোওটাকেই ছোট করে দেখার উপায় নেই। যেমনটা খাটে বিষণ্ণতার ক্ষেত্রেরও। ছোটবেলায় দুঃখ কমানোর জন্য একটা কমন কথা সবসময় ভাবতাম। -আমার থেকে যার কষ্ট বেশি তার দিকে তাকাও। অনেকেরই একটা হাত নাই, থাকার জায়গা নাই বা খাওয়া নাই। আমার তো আর যাই হোক এসব নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে না! আমার তো প্রতি পদেই শুকরিয়া আদায় করা উচিত। আমার কষ্ট তো নিশ্চয়ই তাদের থেকে বেশি না!

কিন্তু এতদিন পর এসে এখন মনে হয় এই কষ্টের কম বেশি ব্যাপারটা আসলে তুলনা করার মতন না। অবশ্যই দুঃখের কম বেশি রকম ফের আছে, তাই বলে একজনের কষ্টকে কি ছোট বা অবহেলা কি করা উচিত? আমার মনে হয় না!

ক্লিওপেট্রা এত কিছুর অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তার জীবনে একাকীত্ব কিংবা দুঃখ কোনটাই কম ছিল না। এই দিক থেকে এত মহান একটা ব্যক্তিত্বকে আমাদের মতন মানুষের কাতারে নিয়ে এসে তুলনা করা যায়। তিনিও হয়তো আমাদের মতনই আবেগে ভরা একজন নারী ছিল! কে জানে!