বেশ কয়েকদিন হলো রহিম সাহেবের কোন খোজ যাচ্ছে না, এদিকে তার বাড়িতে ছোট মেয়েটার খুব অসুখ। গ্রামের মানুষজন সবাই রাহিম সাহেবের বাড়িতে একবার করে ঘুরে আসে কিন্তু তার কোনো দেখা নেই। প্রায় এক সপ্তাহ পর রহিম সাহেবের দেখা মিলে তাও আবার এক চায়ের দোকানে, সে বসে চা খাচ্ছে আর তার চারপাশে বহুলোক বসে আছে, তারা সবাই রহিম সাহেবের গল্প শুনছে মুক্তিযোদ্ধার গল্প ।
জেলার নাম যশোর বাড়ি গোস্টবিহার, পেশায় সে একজন নামকরা ডাক্তার, গ্রামের মানুষ তাকে নুরুল ডাক্তার নামেই চিনে। মানুষ হিসেবে তাকে আমি একটা কথাই বলতে পারি খুবি বিচক্ষণ ও এক ক্তহার মানুষ। তার নামডাক যে শুধু গোস্টবিহারেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয় তার নামডাক আশেপাশের ৮-১০ গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। লোকটি দেখতে যে রকম উঁচু লম্বা তেমনি সু-সাস্থের অধিকারি । মানুষের সাথে মিশতে ভালবাসে, সবার খোজখবর নেওয়া, কেও বিপদে পড়লে সাহাজ্য করা তার অন্যতম বড় গুন। সবথেকে বড় কথা লোকটা ঠিক আমার মতই গল্পবাজ, এইতো সেদিন যখন তার সাথে আমার শেষ দেখা হই তখনও টানা ২ ঘন্টা শুধুই গল্পই করেছে।
কিছুকথা এখানে না বললেই নয় বাংলাদেশে আজও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে যাদের আজও মিলেনি কোন স্বীকৃতি, না কোন সহায়তা, তারা আজও অবহেলিত। এর বড় কারন হচ্ছে কিছু অসাধু লোক যারা অন্যের পরিচয় দিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে দিব্বই, আর সবরকম সুযোগসুবিধা ভোগ করছে। সরকার বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বাতিল করেছে, এ প্রক্রিয়া চলমান। যাইহোক এসব নিকৃষ্ট মানুষদের আইনের আওতাই এনে শাস্তির ব্যাবস্থা করা উচিত।
রহিম সাহেব হঠাত থেমে গেলেন, কি জেন ভাবলেন তারপর আবার বলতে শুরু করলেন। সাল ১৯৭১ সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা চলছে, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই একসাথে যুদ্ধ করছে। নুরুল ডাক্তার তখন ভারতে ট্রেনিং শেষে নিজ গ্রামে ফিরেছে, তার চোখেমুখে শুধু প্রতিবাদের প্রতিচছায়া। সে তার গ্রামে মুক্তিবাহিনী গঠন করতে বদ্ধ পরিকর, যশোর জেলা তখন ৮ নম্বর সেক্টরের আন্ডারে ছিল, নুরুল ডাক্তার এর কথাই দুর-দূরান্ত থেকে মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে। এরপর সে তাদের ট্রেনিং দেয়, এ সময় যশোর ও তার আশেপাশের শহরগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনীর সমাগম বাড়তে থাকে। নুরুল ডাক্তার আর দেরি করেনা তার বাহিনী নিয়ে নেমে পড়ে গেরিলা হামলাই। তখন ডাকা থেকেও মুক্তিবাহিনী যশোরে আশে, তারা নুরুল ডাক্তার এর কথা জানতে পারে তাকে ফিল্ড ককমান্ডারের দায়িত্ব দেয়।
এভাবেই চলতে থাকে, দিনের পর মাস নুরুল ডাক্তার এর নেতৃতে অনেকগুলো অপারেশনে অভাবনীয় সাফল্য আসে। সেদিন ছিল সোমবার, সব মুক্তিবাহীনি মিলে পাকিস্থানি মিলিটারি ক্যাম্পের ঠিক একটি পুরাত্ন জমিদার বাড়িতে সবাই এসেছে। তারা সিদ্ধান্ত নিল তারা মিলিটারি ক্যাম্পে আক্রমন করবে, তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা আক্রম্ন ক্রার সিদ্ধাত্ন নিল। তিনপাশ দিয়ে ঘিরে ধরবে পাকিস্তানি বাহীনিকে। সম্মুখভাগের দায়িক্ত পড়ল ফিল্ড কমান্ডার নুরুলের উপর। অপারেশনের সময় ঠিক করা হয় আগামীকাল সন্ধা ৭ঃ৩০ টা। পরের দিন সকালে নুরুল তার বাহীনি নিয়ে আক্রমনের জন্য প্রস্তুত, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
নুরুল আজ একটু আতংকিত কারন এর আগে এত বড় অপারেশন পরিচালনা করেনি, সন্ধে ৭ঃ৩০ টা মুক্তিবাহীনির সবাই একসাথে ক্যাম্পে আক্রমন করে, তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে মিএ বাহীনির সাথে পাক বাহীনির, সময় ৮ টা বেজে ৪৫ মিনিট, হঠাত একটা গুলি এসে লাগে নুরুলের ডান হাতে, সাথে সাথে তার বৃদ্ধাঙ্গুল পরে যায়। ফিল্ড কমান্ডার নুরুল সে অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যায়। প্রায় ২ ঘন্টা পর মুক্তিবাহীনি পাকিস্থানি ক্যাম্পের দখল নিতে স্ক্ষম হয়। আমাদের স্বাধীনতার পিছনে রয়েছে এরকম বহু মানুষের আত্মত্যাগ, বহু বীর মুক্তিযোদ্ধার তাজা প্রাণ। কথাগুলো বলতে বলতে রহিম সাহেবের চোখে পানি চলে এসেছে।(লেখাটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা)