বাড়িতে আস্তে আস্তে মানুষ জনের আগমন কমতে শুরু করেছে। মা নেই আজ ১৮ দিন হয়ে গেছে। কার এত সময় আছে , নিজের কাজ বাদ দিয়ে অন্যের গোয়ালে ধোয়া জ্বালাবে ?
সবাই গিয়ে শুধু ফুফু বাসায় ছিল। কয়েকদিন ধরেই তিনি ভিবিন্ন কথায় আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে , কাছের কোন মানুষ মারা গেলে খুব সাবধানে থাকতে হয়। মৃতমানুষ টানে , তার আত্মা প্রথম কয়েকদিন আমাদের আশেপাশেই থাকে। আমিও ফুফুর কথা শুনে বিশ্বাস করতে শুরু করি , আর মনে মনে মা কে দেখতে পাবো বলে খুঁজতে থাকি। অবচেতন মনে খুঁজে যাচ্ছি আশেপাশে , মায়ের গন্ধ পেতে খুব ইচ্ছা করছে আমার।
মায়ের আলমারি থেকে বেশ পুরোনো একটা শাড়ি বের করলাম , পড়ে আয়নাতে নিজেকে দেখলাম। ঠিক তখনি ফুফু আমাকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। ভালো করে খেয়াল করে দেখে এটা আমি ছিলাম , আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কথা বলে বলতে লাগলো তোকে একদম তোর মায়ের মতো লাগছে। তুই জন্ম হওয়ার আগে তোর মা ঠিক এমন ছিল।
শাড়িটা খুলে আমি বারান্দায় রোদে দিয়েছিলাম। এর কিছুক্ষন পর বাবা আসলো টেবিলে বসে এক গ্লাস পানি খেলো। বাহিরের আকাশে অনেক মেঘ জমেছে , প্রচন্ড বাতাস বইছে। এর মধ্যে ঘরে কারেন্টও চলে গেলো। বাতাসে বারান্দার পর্দা সরে গিয়ে মায়ের শাড়িটা একটু একটু করে দেখা যাচ্ছে। বাবা হটাৎ করে মায়ের শাড়িটা দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো ও চেয়ারে বসে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো। ...... কে ? ওখানে কে ? আর তখনি বাবার হাত লেগে কাছের গ্লাসটা নিচে পরে ভেঙ্গে গেলো। আমি শুধু তাকিয়ে দেখছিলাম কিছুই বলছিলাম না। দেখলাম বাবা কোনোকিছুই খেয়াল না করে সেই কাঁচ দিয়ে পা কেটে নিজের ঘরে চলে গেলো। বাবা কেন এত ভয় পেয়ে গেলো বুঝে উঠতে পারলাম না।
কাজের মেয়েটাকে দেখে কাঁচের টুকরো গুলো পরিষ্কার করতে বললাম। কাঁচের টুকরো গুলো পরিষ্কার করতে গিয়ে সে আমাকে বলে আপা এই রক্ত কার আপনের নাকি খালুজানের ? আমি কিছুই বললাম না। এখন আমার আর কোনো কথার উত্তর দিতে ভালো লাগে না।
বৃষ্টিটা এখনো হচ্ছে , মনে হয় না আজ রাতে কমবে। ঝড় হচ্ছে রীতিমতো , সাথে আলোর ঝলকানি তো আছেই। আমি বিছানা থেকে উঠে বারান্দার দরজা লাগাতে গিয়ে দেখতে পেলাম মায়ের শাড়িটা বাতাসে উড়ছে।
ইস !!! ভুলেই গিয়েছিলাম শাড়িটার কথা। ভিজে একদম শেষ। এত পুরোনো শাড়ি আর মনে হয়না পড়া যাবে। এখন আর ভেবে লাভ কি ?? যা হবার তা তো হলোই।
রাতে বাবা আর কিছুই খেলোনা ,আমিও কিছু খেলাম না। একটু শীত শীত লাগছে , আবহাওয়াটা কেমন যেন। কাজের মেয়েটা রাতে আমার সাথেই ঘুমাই। হঠাৎ ঘুম ভেংঙে গেলো মাঝ রাতে , কেন ভাঙলো কে জানে? মাথার কাছে ঘড়িটা দেখলাম রাত তখন ২টা বাজে। আমি তখন উঠে গেলাম। জানালার কাছে গিয়ে দেখি বৃষ্টির জোর কমেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তখনও।
আমার হঠাৎ কি মনে হলো , বাবার ঘরের দিকে গেলাম। বাবা মনে হয় এখনো ঘুমাইনি , বাবার ঘুম এখন আর ঠিক মতো হচ্ছে না আজকাল। হবেই বা কি করে প্রতিরাতেই মা উনার পা টিপে দিতো , তবেই তার আরাম করে ঘুম হতো। কিন্তু মায়ের জায়গা হতোনা তার পাশে। ঘর ছিল আলাদা। কেমন যেন এলোমেলো লাগলো বাবার শুয়ে থাকাটা।
হটাৎ আমার মনে হলো আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী আগানো উচিৎ।
তারপর আমার ঘরে ফেরত এসে মায়ের একটা সবুজ শাড়ি গায়ে কোন মতে জড়িয়ে হাতে কিছু কাছের চুড়ি পড়লাম। এবার আস্তে আস্তে বাবার ঘরের দরজায় গিয়ে দাড়ালাম , বাবাকে ডাকলাম '' শুনছেন '' ...
বুকের ভিতরে মনে হচ্ছে কেউ যেন ঢোল পিটাচ্ছে। কি হবে কেউ জানে না , তবে ধরা পড়লে আমি শেষ। কিন্তু শেষ হওয়ার আগে একবার চেষ্টা তো করাই যায়। আমার সমস্ত সাহস একজায়গায় করে বাবার খাটের আরো একটু কাছে গিয়ে একই ভাবে আবার ডাকলাম , এবার একরেকটু জোরে ডাকলাম। ঠিক তখনি বিদ্যুৎ চমকানোর আলোর ঝলকানিতে আমাকে হয়তো আবছায়া ভাবে দেখা গেলো। বাবা আমাকে দেখে কেমন জানি গুঙিয়ে আওয়াজ করে উঠলো ,, কে ? কে ? ওখানে ?
আমি এক দৌড়ে আমার ঘরে চলে আসলাম। ঘরে এসে বালিশের নিচে কাপড়টা খুলে রেখে দিলাম ও কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষন বোঝার চেষ্টা করলাম বাবা আবার আমার ঘরে আসছে কি না ? বেশ খানেক সময় পার হওয়ার পর বুঝলাম মনে হয় আর আসবেনা এদিকে , আর কাটা পা নিয়ে আসবেই বা কি ভাবে।
একগ্লাস পানি ঢক ঢক করে খেয়ে আমি ঘুমিয়ে গেলাম , বলতেই পারলাম না। সকাল হতেই কাজের মেয়েটা আমাকে ডাকতে শুরু করে। .... মীরা আপা ?? খালুজান এর কি হয়েছে দেখেন। আমি এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে উঠেই বাবার ঘরে গিয়ে দেখলাম মুখটা এদিকে কাত হয়ে আছে , আর ঠোঁটটা কেমন যেন বাঁকা। বাবা তাকিয়ে আছে কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছে না। আমি সাথে সাথে আমাদের এলাকার ডাক্তার চাচাকে ফোন দিলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে ডাক্তার চাচা চলে আসলেন। বাবাকে ভালো করে দেখে বললেন , গতরাতে একটা স্ট্রোক হয়েছে , আর পায়ের আঘাতটাও অনেক গভীর হয়ে গেছে।
যেহেতু অনেকটা সময় চলেগিয়েছে তাই তখনি হসপিটালে নিতে হবে। এমন অবস্থায় আমার কিছু করার নেই। বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করা হলো। পাঁচদিন পর বাবাকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসলাম হুয়েই চেয়ারে করে , বাবার একপাশ প্যারালাইজট হয়ে গেছে। পায়েও ব্যান্ডেজ , কাঁচের কাটাটাও ভালো হতে বেশ সময় লাগবে।
কেউ জানলোনা হঠাৎ কি ভাবে ঐরাতে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। ..... আমি মনে মনে বলতে লাগলাম পাশার দান উল্টাবেই। ..... আজ হোক কিংবা কাল।
অদ্ভুত সুন্দর তোমার লেখা গল্প।এভাবেই লিখতে থাকো ❤️❤️
Thank you so much apu. Amar lekha golpoti porar jonno.