ধুলো জমা ডায়েরি

in BDCommunity3 years ago

ধুলো জমা ডায়েরি

আজ কোনো ব্যাস্ততা নেই আমার। হাতে কোনো কাজ নেই, নেই কোনো তাড়াহুড়ো। ঠিক করলাম ঘরদোর ঝাড়া মোছার কাজ করে সময়টা বেশ কাটিয়ে দেয়া যাবে। খাটের নিচটায় ঝাড়ু দিতে গিয়ে শক্ত কি যেনো ঠেকলো। উকি দিয়ে দেখলাম বেগুনি রঙের বেশ বড় একটা ব্যাগ। প্রথমে কিছুই মাথায় আসলো না। খাটের নিচ থেকে ব্যাগটা বের করতেই ধুলোবালিতে একাকার একদম চারপাশ। ঝেড়ে মুছে সব ধুলো সরালাম। এরপর ব্যাগের ভেতর থেকে প্রায় পাঁচ ছয়টার মত পুরনো ডায়েরি বের করলাম। ঠিক তখন মাথায় আসলো আমি নিজেই এগুলো এই ব্যাগটায় ভরে রেখে দিয়েছিলাম। মা অবশ্য কয়েকবার বলেছিল বিক্রি করে দেয়ার কথা। কিন্তু নিজেই কখনো নিজের স্মৃতির ভান্ডার বিক্রি করে দিতে পারে? এও কি সম্ভব কখনো? তাই আর বিক্রি করি নি।

telephone-1600503_960_720.jpg

কখনো অযত্নে ফেলে রাখি নি ডায়েরিগুলো। খুব যত্নে তুলে রাখতাম। যখন যা মনে চাইতো এখানে লিখে রাখতাম। ওইগুলো শুধু আমার কাছে ডায়েরিই ছিল না। আমার প্রতিদিনকার, প্রতি মুহূর্তের সমস্ত কথার সাক্ষী ওরা, আমার হাজারটা রঙিন স্মৃতি ওদের মধ্যে খুব যত্নে জমিয়ে রেখেছি আমি। প্রতিটা ডায়েরির উপরের শক্ত অংশটা নিজের হাতে রঙিন কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছি। যাতে ছিঁড়ে না যায়, পুরনো না হয়। আর সুন্দর করে নকশা একেছি প্রতিটার মলাটের উপর।

এখনো ডায়েরিগুলো ঠিক আগের মতই আছে। আমার ঘরদোর পরিষ্কারের কাজ কোথায় যে পালালো সেই খবর রাখার আর সুযোগ হলো না আমার। আমি মেঝেতে সবগুলো ডায়েরি নিয়ে বসে পড়লাম।একদম প্রথম ডায়েরিটা ২০১৭ সালের। তখন অনেকটাই ছোটো ছিলাম। স্কুলের ছাত্রী ছিলাম তখন। কি আর এমন লিখতে পারতাম তখন, তেমন কিছুই না। তারপরেও তখন থেকেই ডায়েরি লিখতাম। আমার ভালো লাগতো খুব। সারাদিন যা করতাম, যা হতো, যা বলতাম সবকিছু লিখে রাখতাম আমি। ডায়েরির পাতা উল্টাতে লাগলাম। সেই সাথে বারবার ডুব দিচ্ছিলাম স্মৃতির গভীরে।

  • এই,তুমি দাড়াও। বলো আজকে কি পড়িয়েছি।
  • পারি না, মিস।
  • সোজা কান ধরে দাড়িয়ে থাক। ক্লাসের সময় বকবক আর এখন বলে পারি না।
    সেদিন খুব হেসেছিলাম মিস চলে যাওয়ার পর। সেটাও লিখে রেখেছি এখানটায়!
  • এই মেয়ে এই, জাতীয় সংগীত চলছে। তুমি ক্লাসের বাইরে কেনো?
  • আ... আ...আমি মিস, ওয়াশরুমে যাচ্ছি।
  • আমার সাথে মজা করা হচ্ছে। ওয়াশরুম কি এইদিকে?
  • সরি মিস।
    সেদিন এই সরি বলেই যে দৌড়ে পালিয়েছিলাম আর কোনোদিন পিটি মিসের সামনে যাইনি। কপাল ভালো ছিল তাই বেচেঁ গিয়েছিলাম!
  • যাহ, কথা বলবি না আমার সাথে। তোর সাথে আড়ি।
  • যা, যা। বলিস না কথা। কার কী??
    এখনো এই ঝগড়ার কথা মনে করে আমি আর মিথি খুব হাসি।
    এইযে, এত সব সুন্দর স্মৃতি, না লিখে রাখলে কি আবার নিজেকে ঐভাবে আগের ওই সময়টাতে নিয়ে যেতে পারতাম? ঘুরে আসতে পারতাম আগের দিনগুলোকে ছুঁয়ে?? দেখতে দেখতে একটা ডায়রি পড়ে ফেললাম। কিছু স্মৃতি হাসলো, কিছু স্মৃতি কাদলো, কিছু স্মৃতি আবার ভীষণ রাগ আর অভিমানের। আমি আবারও আমার কয়েক বছর আগের সেই ছোট্ট পিংকিকে খুঁজে পেয়েছিলাম। এত ভালো লাগছিলো ভেতরটায়। জীবন কতটা সুন্দর টা খুব কাছ থেকে, নিজের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে বোঝার জন্য হলেও মানুষের এইভাবে স্মৃতি জমিয়ে রাখাটা খুব দরকার।

আমি চোখ টা মুছে নিয়ে আরেকটা ডায়েরির পাতা উল্টাতে লাগলাম। একটা ব্যাপার বেশ হাসালো আমাকে। আমার হাতের লিখাটা বছরের সাথে সাথে উন্নত হয়েছে অনেকটাই! ডায়েরির একেক পাতায় লিখার ধরন একেক রকম। কোনোদিন মন খারাপ নিয়ে লিখেছি, কোনোদিন আবার রাগ ঝেড়েছি এই সাদা পাতায় কালো কালি দিয়ে, কখনো আবার খুব বেশি খুশি নিয়ে এখানটায় লিপিবদ্ধ করেছি আমার সব অনুভূতি।

সময়ের সাথে জীবনের নানা জায়গায় জীবন নানা রূপ নিয়েছে, কখনো হেসেছি, কখনো কেঁদেছি, কখনো চুপচাপ। এতকিছুর মাঝে একদম ভুলেই গিয়েছিলাম আমার ঝুলিতে এত এত সুন্দর কথা লুকানো, এতসব রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় প্রতিদিন। যত পাতা উল্টে যাচ্ছিলাম মনটা তত ভালো হয়ে যাচ্ছিল আমার। নিজের সব দুঃখ,বিষন্নতা,হতাশা সেদিন ভুলে আমি নতুন করে আরো একবার নিজেকে নিজে জড়িয়ে ধরেছিলাম। নিজেকে নিজে আরো একবার নতুন করে সাজিয়েছিলাম আনন্দের সবচেয়ে সুন্দর চাঁদর দিয়ে। মনে হচ্ছিল বিশাল বড়ো কোনো সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে, প্রাণখোলা বাতাস আমার সব অনুভূতি ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। সত্যি বলতে ভালো লাগাটা পরিমাপ করতে পারছিলাম না আমি, ভাষার অভাব পড়ছিল খুব। নিজের ভেতরকার শব্দভাণ্ডার হাতড়ে বেরাচ্ছিলাম, কিছু শব্দ খোঁজার চেষ্টা করছিলাম আমার এই আনন্দটা প্রকাশ করার, পাচ্ছিলাম না।

আমি এখনও ডায়েরি লিখি। যখন যা ইচ্ছে হয় লিখি। যা মনে আসে তুলে রাখি পাতাগুলোয়। বারবার ভাবছিলাম এত আনন্দ কোথায় যে তুলে রাখি! চাইলেই সব লিখে রাখা যায় না। কারণ কিছু অনুভূতি বর্ণনা করার মতো শব্দ মানুষের অজানা থাকে সবসময়।

  • এই যাহ, চুলায় যে চা বসিয়েছিলাম ডায়েরির মধ্যে ডুবে গিয়ে ভুলেই গেছি একদম।
    যাক গে,যা হয়েছে , হয়েছে। আর ভেবে কাজ নেই। এখনো আরো দুইটা ডায়েরি পড়া বাকি! দুপুর গড়িয়ে বিকেল বেলার মিষ্টি বাতাস, ম্লান আলো ঘরে জায়গা করে নিচ্ছিল নিজের ইচ্ছেমত। আমার ভালো লাগা,স্মৃতিতে ভেসে বেড়ানোর আনন্দ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল তখন। খিদা,পিপাসা ভুলে মনে হচ্ছিল স্মৃতিগুলো খেয়েই পেট মন ভরাচ্ছিলাম!
    সবগুলো ডায়েরি পড়ে শেষ করা হয়নি তখনো, কলিংবেল টা বেজে উঠলো। আঁতকে উঠেছিলাম । এই অসময়ে কে?
  • আরে,এই মেঝেতে সব ছড়িয়ে নিয়ে বসে আছিস যে?
    ওহ্, ইশিতা এসেছে। আর আমার স্মৃতির ভিড়ে ডুবে থাকা হলো না। বাধ্য হয়ে উঠতেই হলো। আজকের মত ইতি টেনে দিলাম আমার স্মৃতি পাতার।
    আমি সবসময় এরকম লিখে যাবো, নিজের সব কথা জমিয়ে রাখবো। এইসব ধুলোজমা পুরনো, মলিন ডায়েরিগুলো আমার প্রতিদিনের বেচেঁ থাকার ইচ্ছে যোগায়। নিজেকে ভালোবাসতে খুব সাহায্য করে।
    Image score