বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আর ভেতরে আমি বিছানার উপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। বেলা ১ টা বেজে ৫৫ মিনিট। নাওয়া খাওয়া সব বাদ দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনছি। বারান্দায় শুকাতে দেয়া কাপড়গুলো বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যাচ্ছে একদম । বন্ধ জানালার কাচের দিকে তাকিয়ে আমি দেখছি সেটা। উঠে গিয়ে কাপড়গুলো ঘরে আনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ভিজুক। অন্য সময়ে খুব পারি বাক্য সাজাতে, কাব্য রচনা করতে। আজকে কেমন যেনো এলোমেলো লাগছে মাথার ভেতরটা। ঝুম বৃষ্টি হলেই এমন হয় আমার। কোনোকিছুই গুছিয়ে বলার বা লিখার শক্তিটা কেমন মরে যায়। কেমন যেনো হয়ে যাই হুট করেই। কতকিছু বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু গুছাতে পারছি না। ঘরে কেউ থাকলে ভালো হতো। ওকে ডেকে এনে সামনে বসিয়ে একটা একটা করে সব বলতাম। কেউ তো নেই। ঘরে শুধু আমি আর আমার খুচরো কথা।
অনেক কষ্টে উঠে গিয়ে ছোটো টেবিলের উপর থাকা আয়নাটা নিয়ে এসে আবার বিছানায় বসলাম। আয়নার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলাম.....
আমিও তো চাই,বুকের ভেতর আমাকেও কেউ গুছিয়ে রাখুক। যেমন করে মানুষের কয়খানা হাড়ের নিচে হৃদয়টা খুব যত্নে গুছিয়ে রাখা থাকে....আবার ভাবি এমন হয় নাকি?মানুষ তো চিরন্তন একা। কথাটা শেষ করতেই ঝুলতে থাকা ক্যালেন্ডারটার দিকে চোখ পড়লো। আচ্ছা, ক্যালেন্ডারের ঠিক কোন পাতায় কিংবা কোন তারিখে সুখ লুকানো থাকে? আমার জানা নেই। অনেক খুঁজেও নির্দিষ্ট কোনো তারিখ বা মাস আমি খুঁজে পাইনি। আসলে এরকম থাকে না। নিজের খুঁজে নিতে হয়। কোথায় খুজবো?মানুষের মাঝে?ছেড়ে চলে যাবে, ধোঁকা দেবে, কান্না উপহার দিবে। তাহলে কি সুখ নেই? আছে তো। নিজেকে জড়িয়ে ধরা যায়, নিজের একাকিত্বকে খুব করে জড়িয়ে ধরা যায়। ছেড়ে যাবে না কোনোদিন। সুখের মোড়কে করে বিশাল সমুদ্র সমান কান্না উপহার দিবে না। তাই সুখ দুখ সব ছাপিয়ে মাঝে মধ্যে খুব মনে হয় যে মানুষ একাই ভালো। হঠাৎ মনে হলো আয়নার ভেতরের মানুষ টা বলছে....
-বেরিয়ে এসো।
-কোথা থেকে?
-সেইসব জায়গা থেকে যেখানে তোমার কথার দাম নেই, তোমাকে কেউ বুঝে না, তোমার ছোটো ছোট সাফল্যগুলোর কদর করে না, সেই এক "ভালো রেজাল্ট" আর "ভালো চাকরি" যেখানে সব সেখান থেকে বেরিয়ে এসো।
-তাহলে তো একা থাকতে হবে।
-থাকো, ক্ষতি তো কিছু দেখছি না। নিজের সঙ্গটাই নাহয় উপভোগ করলে। অন্যের রঙ সামলানোর চাইতে এটাই হাজার গুন ভালো।
কথা কিন্তু ঠিক। আমার না মাঝে মাঝেই খুব ইচ্ছে হয় সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে একদম চলে যাই দূরে কোথাও। যেখানে আমি বাদে আর কেউ থাকবে না। ইচ্ছে হয় আফিম খেয়ে একদিন ভেসে যেতে দূরে ওই নীল আকাশের সাদা মেঘের দেশে । আর কোনোদিন ফিরে না আসতে। এইযে সুখী থাকার মস্ত বড় নাটকটা....
একদিন এর অবসান ঘটিয়ে চলে যাবো সমুদ্র দেখতে, কাউকে কিছু না জানিয়েই। একদিন আমার সমস্ত গল্পের শেষের লাইনে লিখে দিব কিছুই পার্মানেন্ট না জীবনে। না আমি, না আমার সুখ দুখ, না আমার বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা রঙিন বাক্সে মোটা কালি দিয়ে মার্ক করা সমস্ত না পাওয়া। একদিন সত্যিই নিখোঁজ হয়ে যেতে চাই কাউকে কোনো খবর না পাঠিয়েই। আমাদের মানুষদের ভেতরে চলতে থাকা, নিজের সাথে বলতে থাকা কথাগুলো কিন্তু প্রায় একরকমই । শুধু ব্যাক্তি ভেদে প্রকাশ করার ধরনটা একটু আলাদা। কিন্তু এইযে সব ছেড়ে নিজেকে নিয়ে পাড়ি জমানোর ব্যাপারটা....হুট করেই পেছন থেকে মায়া, ভালোবাসা টেনে ধরে। এইসব উটকো ঝামেলা না থাকলে দুনিয়াটা বোধহয় একদম ফাঁকাই হয়ে যেত! কারণ, এইগুলোর জন্যই তো মানুষ বাঁচে, সব ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু মায়া,ভালোবাসা যদি ঠিকঠাক না থাকে জীবনটা কেমন বিষিয়ে উঠে.....না?
আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার কোনটা জানো? কথা দিয়ে কথা রাখাটা। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজটা হলো কাউকে ভালবেসে সারাজীবন আগলে রাখার কথা দিয়ে হুট করেই ছেড়ে চলে যাওয়াটা। যদি সত্যিই কারও সাথে সারাজীবন থেকে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে ভেতরে তাহলে নিজের সবটা দিয়ে ওই সম্পর্কটার যত্ন করতে হয়। তাহলেই একটা সুন্দর সমাপ্তি পাওয়া যায়। তাই আমার কাছে মনে হয় ভালোবাসার চাইতে ভালো রাখার যে দায়িত্বটা সেটা সবার আগে দরকার। কিন্তু এরকম সময়ে এমন মানুষ আছে?খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে কিন্তু এখন আপাদত প্রয়োজন দেখছি না। শুধু সময়ই নষ্ট হবে। আমার না এই অনলাইন এর দুনিয়ায় একদম ভাল্লাগে না কেনো জানি। দম বন্ধ, দম বন্ধ লাগে। আগের সময়টা কত সুন্দর ছিল না? প্রিয় মানুষটার কাঁচা হাতের লিখা, বাকা আর ভুল বানানের চিঠি..... এরকম কিছু পাওয়ার মধ্যে যে একটা তৃপ্তি... তা এই টেক্সট করার যুগে কেউ বুঝবেই না। আমি তো বলবো....কোনো দামী উপহার না, আমাকে প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি দিলেই হবে। আমি সেইখান থেকেই ভালোবাসা কুড়িয়ে নিতে পারবো.....সেখানের প্রতিটা শব্দে আমার জন্য অন্তহীন মায়া আর যত্ন লুকানো থাকবে।
কিন্তু এই আধুনিক শহরে কারও চিঠি লেখার সময় হবে না আমি জানি। কেউ তার প্রিয় মানুষটার কথা ভেবে একটা সাদা পাতা আর কলম নিয়ে বসে পড়বে না লিখতে এত ব্যস্ততার মাঝে। তাই কারো কাছে আবদার করার মত সুযোগ নেই যে...."আমার জন্য চিঠি লিখিস মনে করে।"
আমি জানি আমার আজকের কথাগুলো বড্ড এলোমেলো, খাপছাড়া। কিন্তু সাজাতে পারছি না যে ওই অবিরাম বৃষ্টির শব্দের কারণে....আমার কি দোষ?
আচ্ছা, ভালোবাসতে কি কি লাগে? আমার তো মনে হয় ভালোবাসতে শুধু ভালোবাসাই লাগে। যোগ্যতা লাগে না, লাগে মায়া। ক্যারিয়ার, হাইট, সাদা নাকি শেমলা এইসব আজকালকার দুনিয়ার মানুষের চাহিদা হলেও আমার কাছে এইসব ম্যাটার করে না। আমার কাছে তো মনে হয় যার প্রতি মায়া জন্মে তাকে ততই সুন্দর আর যোগ্য লাগে। এইখানে আলাদা করে মানুষটার যোগ্যতা, বাইরের সুন্দরটা কেনো খোঁজা লাগবে? আমি এই সময়ের মানুষদের সুন্দরের প্রতি চাহিদা একদম বুঝি না। বুঝার দরকার ও মনে করি না। ঐযে, কিছু ভালোবাসা থাকে না....যে না ছুঁয়েও ভালোবাসা যায়। কাছাকাছি থাকা যায় না কিন্তু তার মায়ায় ডুবে থেকে তাকে ভালোবাসা যায়। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে ভালোবাসার জন্য ভালোবাসার মানুষটাকে তেমন প্রয়োজন নেই! শুনতে অদ্ভুত কিন্তু সত্যি বলতে এরকম ভালোবাসাটাই বেশি সুন্দর। তার জন্য শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রার্থনা করা যায়। মন থেকে বলা যায় যে মানুষটা যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক। কোনো চাওয়া থাকে না, কোনো পাওয়ার আশা থাকে না, শুধু মায়া......ব্যাপারটা ভীষণ রকমের অদ্ভুত কিন্তু সুন্দর।
এইযে আমরা কত হিসেব নিকেশ করে ভালোবাসি না....এটা একদম অনর্থক মনে হয় আমার কাছে। আরেহ, যেখানে মানসিক শান্তি পাওয়া যায় সেখানেই চলে যাও। পেছনে আর ফিরে তাকানোর দরকারই নেই একদম। কি হবে তাকিয়ে? ওই টাকা, বাড়ি, গাড়ি সবসময় থাকবে? তুমিই তো থাকবে না.... যেকোনো সময় চলে যেতে হবে। তাহলে এত ভালো থাকার, বেশি চাওয়া পাওয়ার হিসেব করে কি পাবা এমন? সবশেষে তো ওই মানুষটার কথাই মনে পড়বে যার কাছে মানসিক শান্তিটা পাওয়া যায় ....চাওয়া ছাড়াই। এইযে মানুষ হিসেব করে যে , কে তাকে কতটুকু ভালোবাসে বা তার সেই অনুযায়ী কতটা ভালবাসা দেয়া দরকার.... আমার কাছে এইসব একদম বিরক্তিকর। মানুষ তোমাকে কতটা ভালোবাসবে কিংবা তুমি তাদের কতটা বাসবে এতসব বুঝার দরকার তো নেই। যে ছেড়ে যেতে চায় সে চলে যাক। এতে নিজের মনকে তো দায়মুক্ত রাখা যাবে, নাকি? যে ভালই বাসবে সে তো ছেড়েই যাবে না আর যে চলে যায় সে তো ভালই বাসেনি কখনো। তাহলে আর এত জোরাজোরি, হিসেব নিকেষের খাতা বানানো.....কি দরকার? আমরা মানুষরা এতকিছু বুঝার পরেও সেই পড়েই থাকি। বড়ো অদ্ভুত আমরা!
এইযে এত ভালবাসি ভালবাসি বলে সবাই....চারপাশ টা একটু দেখলেই বুঝে নেয়া যায় যে তোমাকে ভালোবাসার মানুষের অভাব না হলেও বুঝার জন্য একটা আস্ত মানুষের বড্ড অভাব। অভিমান নিয়ে চুপ হয়ে যাও, বুকে কষ্ট চেপে মুখে হাসি নিয়ে ঘুরে বেড়াও, রুজি রোজগারের চাপে ক্লান্ত তুমি সবটা গুছিয়ে নাও অন্যের জন্য, সারাদিন খেটে যদি একটা ভুল হঠাৎ করে ফেলো.....দেখবে তোমার বাইরের টা দেখার অনেক মানুষ জমে যাবে, ভেতরটা কেউ তাকিয়েও দেখবে না। তাহলে কি এখন মনে হচ্ছে না ভালোবাসার চাইতে তোমাকে বুঝতে পারে এমন একটা মানুষ আগে দরকার? হ্যাঁ, সত্যিই দরকার। তাই আমি বলবো....যদি কোনোদিন বুঝতে পারো যে তোমার জীবনে এমন একটা মানুষ আছে যে তোমার ভেতরটা বুঝতে পারে, সে দেখতে যেমনই হোক তাকে রেখে দিও,খুব করে আগলে রেখো। এমন দিনে এরকম একটা মানুষ পাওয়া কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার। ওই মানুষটাকে ভুল করে হলেও হারিয়ে যেতে দিও না। কেউ যদি তোমাকে বুঝতে পারে তাহলে সেখানে ভালোবাসা কতটুকু সেটা মাপার জন্য দাড়িপাল্লা নিয়ে বসে পড়ার দরকার নেই কারণ তখন এমনিতেই ভালো থাকা যায়। আর যে বুঝতে পারে না তোমার ভেতরটা, তখন ভালোবাসি বলে চিল্লায়ে গেলেও ওইসবের কোনো দরকারই নেই আমি মনে করি। ভালোবাসা ব্যাপারটা এত সহজ না। মুখে বললেই হয়ে যায়না। যত্ন লাগে, বুঝা লাগে, মায়া করা লাগে, আগলে রাখা লাগে, বিশ্বাস করা লাগে তাহলেই হয়। আলাদা করে ভালোবাসি বলার দরকার পড়ে না আর। কিন্তু মানুষ বড্ড বোকা....একটু দামী কিছু উপহার দিলাম, খোঁজখবর নিলাম, ব্যাস....হয়ে গেলো?? না, এইভাবে হয় না। ভালোবাসা যদি আটপৌরে শাড়ির মতো ব্যাবহার করতে চাও তাহলে আর আশা করে লাভ নেই । কারণ তখন আর তার সৌন্দর্য ব্যাপারটা থাকবে না। তোমাকে খুব যত্ন করে নেপথলিন আর চন্দন দিয়ে ভাঁজ করে রাখা জামদানি শাড়ির মতন ভালোবাসাকে দেখতে হবে, ঠিক ঐভাবে যত্ন করতে হবে।
কিন্তু এইযে এতকিছু বললাম.....এত মায়া, ভালোবাসা, তোমার প্রিয় মানুষটা......তাকে ছাড়া বাঁচা যায়? হ্যাঁ, যায় তো.....ঐযে, কালার ব্লাইন্ড হয়ে বেঁচে থাকার মতো বাঁচা যায় চাইলে। তাই সবশেষে ওই এক জায়গাতেই এসে আটকে যাই। কাউকে ভালোবেসে আর মায়ায় পড়ে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে নিজেকে যখন খুশি তখন জড়িয়ে ধরে একা থাকাটাই ভালো বেশি.....তাই না??
আর কিছু মাথায় আসছে না। বৃষ্টি টা থেমে গেছে দু তিন মিনিট হলো। চারপাশটা ঠান্ডা। আবারও আয়নায় তাকালাম। নিজেকে বললাম......
হঠাৎ ঘুম ভেঙে প্রচন্ড জ্বরের ঘোরে যদি কাউকে খুব বেশি মনে পড়ে তোমার সেটাকে ভালোবাসা বলতে পারো আর যদি কখনো পানির তৃষ্ণার চাইতেও কাউকে দেখার তৃষ্ণাটা বেশি কাজ করে ভেতরে তাহলে তুমি মায়ায় পড়ে গেছো।
আমরা মানুষরা এমন ই......নিজেরাই বলি একা ভালো আবার আমরাই চরম ভালবাসা, যত্ন আর মায়ার কাঙাল। মানুষ বড়ই অদ্ভুত, তার জীবনটাও বড্ড হাস্যকর আর রহস্যে ভরা।