বেনামী চিঠি

in BDCommunity3 years ago

বেনামী চিঠি

গল্পটা আজ থেকে ছয় বছর আগের। তখন কলেজ পড়ুয়া সাধাসিধে একটা মেয়ে ছিলাম। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, পড়ালেখায় মোটামুটি ছাত্রী, খুব ছোটো ছোটো ব্যাপারেও বিরাট খুশি কিংবা কেঁদে ভাসানো.... মানে পাঁচ বছরের বাচ্চারাও যতটা বুঝে আমি তারচেয়েও অবুঝ, খুব ছেলেমানুষী করতাম। বাড়ি থেকে কলেজে খুব বেশি দূরের পথ না। পায়ে হেটেই বন্ধুদের সাথে গল্প মেতে মেতে কলেজে পৌঁছে যেতাম প্রতিদিন। আমাদের বাড়িটা চারতলা ছিল। দোতলায় আমরা থাকতাম আর বাকিগুলো ভাড়া দেয়া ছিল। আমাদের বাড়ির চারতলায় ভার্সিটি পড়ুয়া এক ছেলে একাই থাকতো। ওর বাবা মা কি করেন, কোথায় থাকেন এত খোঁজ কেউ নিতে যায়নি। ছেলে টা চুপচাপ, ভালই ছিল মোটামুটি। আমার আর তার বয়সের পার্থক্য ছিল চার বছর। আমি তেমন পাত্তা দিতাম না অন্য দিকে। আমার তো ওই কলেজে যাওয়া, আড্ডা দেয়া, দেখাদেখি করে পরীক্ষায় লিখা, আইসক্রিম খেতে খেতে বাড়ি ফেরা....এসব ই ছিল সব।

আমাদের ছাদটা আবার বিশাল বড়ো। প্রতিদিন বিকেলে ছাদে গিয়ে আকাশ দেখা আমার রুটিন ছিল। আর সেই ছেলে প্রতি বিকেলে ছাদে বসে বই পড়তো।
একদিন ছাদে, কৌতহল বশতঃ ছেলেটা কে প্রশ্ন করলাম...

  • আপনার বাবা মা নেই?
  • আছে।
  • কোথায় থাকেন তারা?
  • গ্রামে।
  • আপনি এখানে একা থাকেন কেনো?
  • আমার ইচ্ছে, তাই
    প্রশ্নের এরকম ছাঁকা ছাঁকা উত্তর দিলে কথা বলতে ভালো লাগে না। আর কি কালো মুখ করে কথার উত্তর দেয়। এর সাথে কথা বলে কাজ নেই। এরপর আর কখনোই তার সাথে কথা বলিনি আমি। এরকম ভাব দেখানো মানুষ আমার অসহ্য লাগে একদম। একদিন মায়ের কাছে আবদার করলাম আমাকে বিড়াল কিনে দেয়ার জন্য। মা তো মানবেই না। ওনার এক কথা....না মানে না। ঘরে বিড়াল আনা যাবে না। মনটা খুব খারাপ হয়েছিল সেদিন। গোমড়ামুখো হয়েই সেদিন ছাদে বসেছিলাম। বিরক্ত লাগছিলো খুব। হঠাৎ ওই ছেলেটা একটা বড়ো ঝুড়িতে খুব সুন্দর দুটো বিড়াল নিয়ে ছাদে উঠলো। আমার তো দেখেই কান্না পাচ্ছিল খুব। মনে মনে বললাম "এই ভাব দেখানো লোকের আবার বিড়াল পালার শখ হয়েছে, যত্তসব। বিড়াল পালবে হাসিখুশি মানুষরা, যারা অনেক সুন্দর করে কথা বলে, সবার সাথে মিশতে পারে তারা বিড়াল পালবে।

মন খারাপ টা আরো বেড়ে গেলো। ছাদ থেকে চলে যাচ্ছিলাম এমন সময় ডাক পড়লো পেছন থেকে।

  • এইযে, শুনছেন, আপনার নাম টা তো জানি না। কিন্তু একটু কথা ছিল।
  • আমি ভাব দেখানো লোকদের সাথে কথা বলি না।
  • আচ্ছা বলতে হবে না। কিন্তু বিড়াল দুটো নিয়ে যান।
    মনে হলো মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ভাবলাম এই ছেলে জানলো কি করে?
    ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম...
  • লাগবে না আপনার বিড়াল। আপনার বিড়াল আপনি আমাকে কেনো দিবেন?
  • লাগবে, লাগবে। মায়ের কাছে যে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন শুনেছি।
  • তো, তাতে আপনার কি? আর মা মেয়ের কথা কান পেতে শুনেছিলেন কেনো?
  • অত জোড়ে চেঁচিয়ে বললে এমনিতেই শুনতে পায় সবাই।
  • লাগবে না আমার বিড়াল।
    চলে এলাম ছাদ থেকে। রাগে দুঃখে কেঁদেই ফেললাম। এরপর দিন সকাল বেলা কলেজের জন্য বের হবো, দরজার বাইরে বিড়াল দুটোকে দেখলাম আবার। ভেতরে খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম একদম কিন্তু মুখে বললাম....
    মা,এই বিড়াল কার?এইখানে কেনো এইগুলো?
  • তোর জন্য কে যেনো উপহার পাঠিয়েছে। দারোয়ান ভাই দিয়ে গেলো। আমি তো কিনে দেইনি। এগুলোই রেখে দে।
    ইচ্ছে হচ্ছিল মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। তা না করে রাগী গলায় বললাম
  • লাগবে না আমার এইসব। কলেজে যাচ্ছি, এইগুলো গিয়ে দিয়ে এসো দারোয়ান চাচার কাছে। মা আর ফেরত দেয়নি। ঘরে এনে খাবার খাইয়ে বিড়াল দুটোকে আমার ঘরে রেখে দিয়েছিল। কলেজ শেষে বাড়ি ফিরে দরজায় টোকা দেবো এমন সময় পায়ের কাছে একটা চিঠি দেখলাম। হাতে তুলে নিয়ে বেগুনি খামটা খুলতেই ছোটো একটা চিরকুট
  • " তোমার কন্ঠটা সুন্দর"
    একদম হকচকিয়ে গেলাম। কোনরকম নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের ঘরে গেলাম। হাতমুখ ধুয়ে দুপুরের খাবার টা সেরে নিয়ে ভাবতে বসলাম কে লিখতে পারে এমন কিছু। ওই ছেলের কথা মাথায় এসেছিল প্রথম। পরে ভাবলাম হাতেগোনা দুইদিন কথা বলেছি মাত্র। নাহ্,ওই ছেলে লিখবে না এইসব। কোনো সম্ভাবনা নেই। একরকম মাথা থেকে জোর করেই সরিয়ে দিলাম চিরকুটের কথাটা। নিজের কাজে মন দিলাম। এভাবে চলছিল দিন। একদিন মা কে বললাম
  • মা,শরীর টা ভালো নেই। আজ কলেজ যাবো না।
  • আচ্ছা, যেতে হবে না, বিশ্রাম নে তাহলে।
    সারাদিন বিছানায় পরে রইলাম। ঠিক বিকেল তিনটে। দরজায় টোকা পড়লো। মা দরজা খুলতেই দারোয়ান চাচা অনেকগুলো বেলী ফুলের মালা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
    মা আমাকে দিয়ে বললো
  • রহিম ভাইয়ের মাথায় মনে হয় সমস্যা হয়েছে। উনি দুইদিন পরপর কিসব নিয়ে হাজির হচ্ছে। আজ আবার বেলী ফুলের মালা
  • ভালই তো। আমাকে দাও দেখি।
    খুব সাধারণভাবে হাতে নিলাম। কিচ্ছু ভাবলাম না। ফুলগুলোর মধ্যে নাক গুঁজে দিলাম। পুরোটা শরীর মনে হলো ভালো হয়ে গেছে একদম। খুব শান্তি পাচ্ছিলাম ভেতরটায়। ফুলের মধ্যে এই একটা ফুল যেকোনো সময় আমার মন ভালো করে দেয়। কিন্তু এই কথা তো মা বাদে আর কারো জানার কথা না। অত মাথা ঘামালাম না। যেই দিয়েছে ভালই করেছে। সারাদিন শেষে এখন কিছুটা ভালো লাগছে।
    হাতে ফুলের মালাগুলো পেঁচিয়ে আয়নায় নিজেকে একটু দেখে নিয়ে ছাদে গেলাম। ছাদে যেতেই দেখি, আমাকে বিড়াল উপহার দিয়েছেন যে ভাব দেখানো মশাই, উনি বসে খুব মনযোগ দিয়ে কি যেনো একটা বই পড়ছেন। আমার পায়ের শব্দে মাথা তুলে তাকালেন। বললেন....
  • বাহ্, এই সময় এত বেলী ফুলের মালা!কোথায় পেলেন?
  • আপনার জেনে কাজ কি তাতে? আপনি আপনার বই পড়ুন।
  • এত সুন্দর দুটো বিড়াল দিলাম, একটা ধন্যবাদ দিতে কি খুব কষ্ট হবে?
  • মুখ টা বাঁকিয়ে ধন্যবাদ বলে ছাদ থেকে চলে এলাম। ওনাকে পছন্দ হয় না আমার। সবসময় কেমন একটা ভাব নিয়ে বসে থাকে। কি আজব মানুষ!

কলেজ শেষে একদিন ফুচকা খাবো, তাই বন্ধুদের নিয়ে ফুচকাওয়ালা মামার কাছে গেলাম। ওনার সামনে গিয়ে দাড়াতেই উনি হেসে বললেন

  • কি মামনি, এসেছো? নাও, আজ যত ইচ্ছা মন ভরে খাও, পয়সা দিতে হবে না। আমরা সবাই অবাক। কারণ জানতে চাইলে মামা কিছু না বলে শুধু হাসলেন। আমরা সেদিন ফুচকা খেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছিল না। ও হ্যাঁ,আরেকটা কথা। ঐযে একটা চিরকুট পেয়েছিলাম....তারপর থেকে প্রতিদিনই একটা করে চিরকুট থাকতো আমার জন্য। কোনো নাম ঠিকানা নেই। শুধু ছোটো করে কিছু একটা লিখা। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং মনে হলো। মাথায় ঝেঁকে বসেছিল যেভাবেই হোক এই বেনামী চিঠির প্রেরক টা কে তা বের করতেই হবে। কোনোভাবেই কোনো হদিস পাচ্ছিলাম না সেই প্রেরক মহাশয়ের। একদিন হাল ছেড়ে দিলাম। অত খুঁজে কাজ নেই। ওনার কাজ উনি চিরকুট দিয়ে যাক। শুধু শুধু আমার এত সময় নষ্ট করলাম।

একদিন সন্ধ্যা বেলায় বসে পড়ছি ঘরে, দরজায় টোকা পড়লো। মা ঘরে ছিল না। আমি গিয়েই দরজা খুললাম। রিদিতা আর নাফিসা এসেছে। কিন্তু ওদের হাতে এত এত ফুল আর চকোলেট! ওরা তো নিজের পকেট থেকে আমাকে দশ টাকা খাওয়াতেই আহাজারি!

  • কিরে,এইসব পেলি কোথায়? কার জন্য এইগুলো?
  • আর বলিস না,দোতলায় উঠছিলাম দারোয়ান চাচা এসে এগুলো দিয়ে গেলো,বললো তোকে দিতে।
  • ওহ্, হ্যাঁ....একটা চিঠিও দিয়েছে সাথে।
    নাফিসা চিঠিটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি ওটা হাতে নিয়ে ওদের কে ঘরে আসতে বললাম। এরপর এই কদিনে যা হয়েছে সব বললাম।
  • ইসস,এমন একটা প্রেমিক পুরুষ যদি আমারও জুটত!
  • হ্যাঁ রে,আমারও !
  • এই ,থাম তো তোরা। বাজে বকিস না। আমি এইখানে চিন্তায় মরছি আর তাদের প্রেম করার সাধ জেগেছে।

এইভাবে প্রায় প্রতিদিন চিঠি, ফুল, চকোলেট, বেলী ফুলের মালা, রং তুলি....এক কথায় আমার পছন্দের কোনো কিছু বাদ পড়ে নি। কত কত বইও উপহার পাওয়া হয়ে গেছে এই কদিনে। কার এত টাকা হলো পকেটে যে আমাকে এইভাবে দিচ্ছে এটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না আমি। একদিন ছাদে গিয়ে খুব সুন্দর বেলী ফুলের একটা গাছ দেখলাম। এমনিতে আমার অনেকগুলো ফুলের চারা কিন্তু বেলী ফুল টা ছিল না। দুদিন আগেই কলেজ থেকে ফেরার পথে একটা বেলী ফুলের চারা দেখে দরদাম করেছিলাম। দামে মিলেনি দেখে আর কিনা হয়নি। এখন এই বেলী ফুলের চারা কার বুঝতে পারছি না। এটাও কি আমার জন্য! হঠাৎ করেই সেই ছেলেটা এলো ছাদে। এসে দিব্যি বেলী ফুলের চারাটায় পানি দিলো গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে। আমি এত অবাক হয়েছিলাম সেদিন। আরেহ,এই ছেলে গান গাইতে পারে! আজকে যার সাথে সংসার করছি সেই তিনি। প্রতিদিন বিকেলে আমাকে গান গেয়ে শোনায়। মুগ্ধ হয়ে শুনি শুধু।
হ্যাঁ, এই ভাব দেখানো, গোমড়ামুখো ছেলেটাকেই বিয়ে করেছিলাম আমি। সেই লুকিয়ে লুকিয়ে খোঁজ রাখতো আমার, আমার সব প্রিয় জিনিস আমাকে উপহার দিতো, সবার চোখের আড়ালে আমার জন্য চিরকুট রেখে যেত। এই সেই বেনামী প্রেরক, যিনি আমার সাথে প্রথম সেদিন কথা বলেই আমাকে ভালোবেসেছিলেন, প্রেমে পড়েছিলেন আমার কণ্ঠের। আর আমি একদম টেরই পাইনি। সেই আমার বেনামী ভালোবাসা যে কিনা শুধু আমার জন্য এতসব করতো, আমাকে খুশি রাখার জন্য।

আমাদের বিয়ের দুইবছর হয়ে গেছে। কিন্তু আজও সে চিরকুট লিখে আমার জন্য, শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমার জন্য বেলী ফুলের মালা নিয়ে আসতে তার কোনোদিন ভুল হয় না। যখনই ইচ্ছে হয় সুন্দর সব শাড়ী কিনে নিয়ে আসে। আর বলে তার জন্য পড়তে। শাড়ী পড়ে, খোঁপায় বেলী ফুলের মালা গুঁজে, চোখের নিচে ভরাট করে কাজল .....তখন তার কাছে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কেউ। তার তাকানোর মধ্যে একটা তৃপ্তি খুঁজে পাই সবসময়। আমি বেনামী চিঠির প্রেমে পড়েছিলাম আর উনি আমার। কিন্তু কোনোদিন বুঝতে দেয়নি, বলেও নি। ঠিক সময় মত একদিন সন্ধ্যা বেলায় আমাদের বাড়ি এসে বললো

  • আসসালামু আলাইকুম চাচী। কিছু কথা ছিল আপনার সাথে।
    আমি তো আমার ঘরে বসে হেসেই কুল পাচ্ছিলাম না। ভাবছিলাম এই লোক নাকি কথা বলবে! উনি তো কথাই বলতে পারে না ঠিকমত।
    সে সেদিন এত সুন্দর করে আমার মায়ের কাছে আমাকে চেয়েছিল।
  • বাবা, আমার মেয়ে তো কিছুই পারে না। শুধু কয়টা ভাত ফুটিয়ে খেতে পারে। ডিমভাজি আর আলুর ভর্তা দিয়ে কি আর তোমার সংসার চলবে? উল্টো আমার মেয়েকে কথা শুনতে হবে।
  • আমি পারি রান্নাবান্না। আর কেউ ওকে কথা শুনাবে না। ও শুধু আমার পাশে থাকলেই হবে। ওর হাতের ডিমভাজি আর আলুর ভর্তা টাই আমি প্রসাদ মেনে খেয়ে নিব। মা কেনো জানি সেদিন ফিরিয়ে দিতে পারেনি ওকে।

আমাদের বিয়ের পর এই দুইবছর এ ওর কাছ থেকে কতকিছু যে শিখেছি তার হিসাব নেই। রান্নাবান্না টা পুরো ও ই শিখিয়েছে আমাকে। আমার এখনো ভাবতে ভালো লাগে। কত কপাল নিয়ে জন্মেছিলাম আমি। কোনো রাগ নেই, বকা ঝকা নেই, অভিযোগ নেই। ঠিক আমার মা যেমন আমাকে আগলে রেখেছে সবসময় ও তেমন টাই। এত সুন্দর করে বুঝে নিয়েছিল আমার ভেতরটা। আমার বেনামী চিঠির ভালোবাসাটা আমার জন্য অনেক সুখ নিয়ে এসেছিল সাথে করে, অনেক সুখ, অনেক আনন্দ যা বলে শেষ করার মত না।

school-work-851328_960_720.jpg

Image score