প্রিয় মানুষের সাথে ছুটির দিনে

in BDCommunity3 years ago (edited)

প্রিয় মানুষের সাথে ছুটির দিনে

20210903_234950.jpg

আজ ঘুম ভাঙলো অনেকটাই দেরিতে। কাজ নেই, তাড়াহুড়ো নেই তাই পুরো সপ্তাহের ঘুমের ঘাটতি এই একটা দিনেই আমাদের পূরণ করতে হয়। আমাদের বলতে আমি আর আমার প্রিয় মানুষটা। আমাদের সংসারের বয়স চার বছর। একদম বিয়ের আগে থেকে ওর সাথে পরিচয় থেকে নিয়ে বিয়ে করা, ওর মত একটা রহস্য আর মজায় ভরা একটা মানুষের সাথে সংসার এই সবকিছুই আমার মনডায়েরিতে থাকা খুব সুন্দর সুন্দর কিছু স্মৃতি। আচ্ছা এইযে নিজের সাথে বসে বসে বকবক করছি, ওকে তো ডেকে তুলতে হবে।
-এই, উঠো। বেলা বারোটা বেজে গেছে। আর কত ঘুমাবা?
-আর পাঁচ মিনিট.... প্লিজ।
-এক মিনিট ও না। উঠো বলছি।
-উফ্, আচ্ছা আচ্ছা উঠছি....
ওকে হাতমুখ ধুতে ওয়াশরুম এ পাঠিয়ে দিয়ে আমি আবারও শুয়ে পড়লাম। ভাবছিলাম আমাদের প্রথম দেখা আর বিয়ের দিনের কথাটা। এত ভালো লাগছিলো।
-এই ঐখানে কে?কে শুনি?বারবার উকি দিচ্ছে কে?
-কেউ না।
-কেউ না হলে কথা কি ভুত বলছে?
সেদিন ও খুব ছুটে পালিয়েছিলো।
আমি তখন মেডিকেলের স্টুডেন্ট। থার্ড ইয়ারে পড়ছি। ও আমার সাথেই, একই ক্লাস। কিন্তু সাবজেক্ট ভিন্ন। পড়ালেখা তেমন করতো না, কোনো কাজ সময়মতো করতো না। আর এইজন্য ওর মা সারাদিন ওকে খুব বকতো। আমাদের বাড়ি পাশাপাশি ছিল বিধায় ওর মা সারাদিন বলে বেড়াত
-দেখেছিস, পাশের বাড়ির আয়েশাকে দেখ। কি ভালো একটা মেয়ে, সারাদিন পড়ালেখা। আর অন্য কোনো দিকে মন নেই। আর তুই? ফোন, টিভি, খেলা, আড্ডা..একদম যাচ্ছেতাই অবস্থা। আর তারপর থেকেই ছেলে তার মায়ের কথামত আমার পড়ার ঘরের জানালা বরাবর এসে উকি দিতো,আমাকে দেখতো! একদিন রাস্তায় আমাকে দেখবে বলে দাড়িয়ে ছিল সে। আমাকে দেখেই অন্যদিকে তাকানোর ভান। কাছে গিয়ে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-আমাকে ফলো করা হচ্ছে?
-কই না তো...
-মিথ্যে কথা আমার একদম পছন্দ না।
-হ্যাঁ, দেখছিলাম আপনাকে।
-কেনো?
-না মানে দূর থেকে তো ঠিক বোঝা যায় যে আপনার ঠোঁটের নিচটায় ওটা কি তিল নাকি কোনো দাগ তাই আর কি.....
-কোনো দাগ না, ঐটা তিল। আমিও তো দূর থেকে ঠিক বুঝতে পারি না তোমার ঠোঁট কালো কিনা। আরেহ, আসলেই তো কালো। সিগারেট খাও নাকি?
-না মানে ....ওই মাঝে মধ্যে আর কি!
-তুমি জানো দুটো সিগারেটের দাম দিয়ে এক প্লেট ফুচকা পাওয়া যায়। এখন থেকে কোনো সিগারেট না। খেতে ইচ্ছে হলে ফুচকা খাবা।
-আচ্ছা।
লজ্জায় লাল হয়ে সেদিন চলে গিয়েছিল সামনে থেকে। আর আমি হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরেছিলাম।
এইসব পুরনো সুন্দর কথাগুলো যখন ভেবে হাসছি ঠিক তখন....
-কই আমাকে তো ঘুমুতে দিলে না। এখন নিজে শুয়ে আছো কেনো?
-এমনিতেই।
-দেখি জ্বরটা বেড়েছে কিনা? এই বলে কপালে হাত রেখে সে আমার জ্বরটা মেপে নিলো। বললো...
-আজকে কোনো রান্নাবান্না করার দরকার নেই। আরাম করো। যা করার আমিই করব আজকে। সময় সুযোগ তো হয় না। আজকে ছুটির দিন, নিজের হাতে রান্না করে বউকে খাওয়াবো।
এই বলেই সে রান্নাঘরে গেলো আমাদের দুইজনের জন্য চা বানাতে। গতকাল থেকেই জ্বর। রাতের অর্ধেকটা সে আমার মাথায় জলপট্টি দিয়ে আর আমার হাত ধরে গল্প করেই কাটিয়ে দিয়েছে। এখন আবার রান্না। ও মানুষটা দারুন। এত যত্ন করে, মুখে কিছু বলে না, বুঝতেও দেয় না। বেশিরভাগ সময়ই হাহা করে হাসি। জানতে চাইলে বলে সেটা অজানা, নাহলে বলবে, সব জানতে হয় না। আমিও আর অত জোর করি না। আমি উঠে দাত ব্রাশ করতে বাথরুমে গেলাম। দাত ঘষতে ঘষতে আবারও মনডায়েরির পাতা ওল্টাতে লাগলাম। আমাদের প্রেমটা খুব হয়েছিল। তাও খুব অল্প সময়েই। কিন্তু এর মাঝেই বাবা একদিন ছেলে দেখলেন। ছেলে নাকি খুব ভালো, স্টুডেন্ট দারুন, ভালো একটা পোস্টে চাকরি। শুনে ভেতর টা খারাপ হয়ে গেলো একদম। ওকে ডেকে এই খবর দিতেই ও বললো
-বাহ্, ভালো তো।
সেদিন এত রাগ হয়েছিল। চুপচাপ চলে এলাম। অনেক দিন কথা বলিনি। প্রায় এক সপ্তাহ পর সে আমার পড়ার ঘরের জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো এক মুঠো চুড়ি আর দুটো গোলাপ নিয়ে। জানালাটা আর লাগিয়ে দিতে পারলাম না না। ওইগুলো দিয়েই সে জানালার বাইরে হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে চাইলো তার নিজের জন্য।
ও তখন একদম বেকার। পড়ালেখায় ভালো না, রেজাল্ট খারাপ। তারপরও কি ভেবে যেনো বাবার সামনে গিয়ে কোলে মাথা রেখে খুব কাদলাম সেদিন। বাবা মেনে নিয়েছিল। ছেলের এত তাড়াহুড়ো ছিল আমাকে বিয়ে করার, সে তার মাকে চমকে দিবে বলেই মাকে কিছু না জানিয়ে বিয়েটা সেরে ফেললো। এরপর তার বাড়ির দরজায় টোকা দিতেই যখন তার মা দরজা খুললো, উনি তো একদম অবাক।
-মা,তুমি সবসময় বলতে না....পাশের বাড়ির ওকে দেখতে। অত দূর থেকে তো ভালোমতো দেখতে পাই না। তাই একবারে কাছে নিয়ে এলাম যাতে দেখতে সুবিধা হয়।
-ভালো করেছিস। কিন্তু তোর তো কোনো চাকরি বাকরি নেই । বউকে কি খাওয়াবি,শুনি।
-মা , অত বেশি সে খায় না। ডাক্তার মানুষ তো, খুব নিয়ম মেনে চলে।
আমাদের এরকম পাগলামি সেদিন তার মা ও মেনে নিয়েছিল। আর কিছু বলেননি। নিজের মেয়ের মতো আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা একসাথে, ঠিক আগের মত।
-কি হলো? আর কতক্ষন দাত মাজবেন আপনি?চা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
একটা মুচকি হাসি দিয়ে সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে এসে চায়ের কাপটা হাতে নিলাম। খুব খুশি হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই....
-এটা কি বানিয়েছো?
-কেনো ! চা....
-সেটা তো জানি....কি দিয়েছো চায়ের মধ্যে?
-দাড়াও খেয়ে দেখি
দুইজন একসাথে হেসে উঠলাম। ও ভুলে লবণ টা মিশিয়ে দিয়েছে চিনির বদলে। তারপর আবার নতুন করে চা বানিয়ে খেলাম দুইজন। দুপুরের রান্না টা ওকেই করতে দিতে হবে বলে জেদ ধরলো খুব। আমার নাকি জ্বর বেড়ে যাবে তাই রান্না সে করবে। আচ্ছা করুক যা ইচ্ছা।
বেলা তখন দুইটার কাছাকাছি। আমি গোসল, নামাজ সেরে নিলাম। আর সে রান্না সেরে গোসল নামাজ সব শেষ করলো তাড়াতাড়ি করে। দুইজন একসাথে খেতে বসলাম। মুরগির মাংস, ছোটো মাছ, ডাল ভুনা, দু তিনরকমের ভর্তা....বিরাট আয়োজন।
ভাত মেখে মুখে দিতেই.....
-আচ্ছা একটা কথা বলি?
সে খুব খুশি হয়ে বলল...- হ্যাঁ,বলো।
-এত মিষ্টি মিষ্টি লাগছে কেনো? কি দিয়েছো?
-কি? দাড়াও।
সেও খাবার মুখে দিয়ে বলে উঠলো
-এত মিষ্টি কেনো?? তাহলে কি এইবার লবণের জায়গায় চিনি?
কেউ আর হাসি আটকাতে পারলাম না। এগুলো খাওয়া সম্ভব না। আমি বললাম, বাইরে থেকে কিছু এনে খাওয়া যায় কিনা। তারপর তেহারি অর্ডার করিয়ে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারলাম আমরা বিকাল সাড়ে চারটার পরে। এতকিছুর পরেও সে রাতের রান্না করতে চাইলো। কোনরকম জোর করে তাকে থামালাম। নাহলে রাতে না খেয়ে থাকা লাগবে! সন্ধ্যায় খুব ইচ্ছে হলো ফুচকা খেতে। ঘরে সবকিছু ছিল। নিজের হাতে ফুচকা বানিয়ে প্লেট সাজিয়ে আমরা নাটক দেখতে বসলাম একসাথে। ফুচকা খেতে খেতে কয়েকটা নাটক দেখলাম দুইজন একসাথে। রাতের বেলায় সে আবদার করলো আমার হাতের ভুনা খিচুড়ি আর গরুর মাংস ভূনা খাবে। প্রিয় মানুষটার আবদার ফেলি কি করে? নাটক দেখা শেষে রান্নাঘরে কাজে লেগে গেলাম। সে বসে রইলো না। যখন যা লাগে এগিয়ে দিলো, পাশে দাড়িয়ে খুব সাহায্য করলো। রান্না করার পাশাপাশি তাকে চিনি আর লবণের পার্থক্য বুঝলাম আমি। একসাথে গল্প করতে করতেই রান্নাটা হয়ে গেল। রাত তখন এগারোটার কাছাকাছি। একসাথে বসে রাতের খাবারটা খেয়ে নিলাম দুইজন।
একটু রেস্ট নিয়ে শুয়ে পড়ব এমন সময় সে বলে উঠলো....
-আমার না আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব।
-এই রাতের বেলায়!
-হ্যাঁ।তোমার যদি হুটহাট ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছে জাগতে পারে....তাহলে আমার ক্ষেত্রে আলাদা কেনো হবে?
-আচ্ছা সেটা নাহয় মানলাম। কিন্তু এত রাতে আইসক্রিম পাবো কোথায়?
-চলো,তৈরি হয়ে নাও। ঘুরতে বের হবো এখন।
-তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা। এত রাতে ঘুরতে যাবো কেনো?
-কারণটা অজানা থাকুক। চলো,একটু হেটে আসি এই রাতের বেলায় আর আইসক্রিম খুঁজে বের করে খাবো।
-তোমার পাগলামির শেষ নেই। আচ্ছা,বসো একটু।
তারপর বোরকাটা পড়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। আর সে এক ফাঁকে আমার জ্বরটা হাত দিয়ে মেপে নিলো। বললো....
-জ্বরটা আর বাড়বে না। আর বাড়লে আমি তো আছিই।
আমি হাসলাম খুব তার এই কথায়। এরপর দুইজন তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাতজাগা পাখির মতন বাড়ি ছেড়ে। অনেকক্ষণ হাটলাম আমরা হাত ধরে, অলিগলি ধরে ধরে। আইসক্রিম খুঁজতে খুঁজতে অনেকটা দূর চলে এলাম। অবশেষে পাওয়া গেলো একটা দোকান। আমার শরীরটা আবারও গরম হয়ে আসছিল। আইসক্রিম কিনে নিয়ে দুইজন রিকশায় বসে বাড়ি ফিরলাম, খুব গল্প করলাম আমরা। বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে আমাকে খুব যত্ন করে বিছানা তৈরি করে দিলো ঘুমানোর জন্য। আমি শুয়ে পরলাম আর সে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। ঘুমিয়ে যাওয়ার ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগে অজান্তেই মুখে হাসি ফুটলো। আজকের ছুটির দিনটা আমার প্রিয় মানুষটার সাথে দারুন কেটেছে,খুব দারুন।