আঁধার রাতের স্মৃতিচারণ

in BDCommunity3 years ago

আঁধার রাতের স্মৃতিচারণ

planet-4848364_960_720.jpg
Image score

রাত দুইটা বেজে সাতাশ মিনিট । চারপাশ টা খুব ভয়ংকর রকম শান্ত , একদম চুপচাপ সবকিছু । এই কংক্রিটের শহরে ইট বালির দেয়ালে ঘেরা প্রতিটা মানুষ এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যান্ত্রিক এই জীবনে আস্তে আস্তে একটা যন্ত্র মানব হয়ে যাচ্ছি এমন মনে হয় মাঝে মাঝেই। প্রায় সময়ই এই নিশ্চুপ সময়টাতে হাতে একটা বড় মগে ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে বসে পড়ি আমার অন্ধকার বারান্দাটায়। অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করতে থাকে ভেতরটায় । কোনখানে কোনো শব্দ নেই , কাজ শেষ করার কোনো তাড়াহুড়ো নেই , মানুষের কোনো হাকডাক নেই। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে নিজের জন্য এই একটুখানি সময় আমি মন ভরে উপভোগ করি ।

নিজের সাথে নিজে কথা বলি। কত রকম স্মৃতি ভাসে তখন চোখের সামনে। কোনো স্মৃতির আগমনে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায় আনন্দে , কোনো স্মৃতি আবার ভীষণ প্রিয় , একান্ত আপন রকমের। কোনো স্মৃতি আবার ভেতরকার অনুভূতির দেয়াল ঘেঁষে প্রচন্ড একটা হাহাকার তৈরি করে সমস্ত শরীরের ভেতর। এত শত ব্যাস্ততার ভিড়ে কোথায় যে মুখ লুকায় আমার অনুভূতিগুলো , আমি টের পাই না তখন। কিন্তু যখন ই সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে নিজের জন্য বের করা সময়টার কাছে হাজির হই , নিজের ভেতরকার সমস্ত অনুভূতির জড়ো করা উঠোনে পা ফেলি ঠিক তখনই হুট করে উকি দেয় আমার সমস্ত স্মৃতিরা। আমি বড়ো দুর্বল ওদের সামনে। ওদের তাড়িয়ে দিতে পারি না চোখের সামনে থেকে। আমার নিজের জন্য তৈরি করা সময়টা থেকে ওদের দূরে ঠেলে দিতেও পারি না।

এতসব কথা আর স্মৃতির মাঝে চায়ের মগটায় চুমুক দেয়ার কথা একদম মনেই থাকে না। নিজের এসব উদাসীনতা ,খামখেয়ালী আমাকে বড্ড হাসায়। ঐযে , মনে পড়ে,স্কুলে যখন পড়তাম কী প্রাণখোলা হাসি ই না ছিল আমার! কত রঙিন ছিল দিনগুলো , কত সুন্দর ছিল প্রতিটা দিন। ব্যাস্ততার মাঝেও দারুন উপভোগ করতাম প্রতিটা দিন। দুই বেনি করে কাধে ব্যাগ নিয়ে স্কুল যাওয়া, বান্ধুবীর জন্য জায়গা রাখা,একসাথে হেসেখেলে ক্লাস করা,স্যারের বকুনিতে হাসির শব্দ আরও দুগুন বেড়ে যাওয়া ,টুকটাক ক্লাস ফাঁকি,ছুটির ঘন্টা বাজতেই একছুটে ক্লাস ছাড়িয়ে স্কুল মাঠে ,সেখান থেকে বান্ধুবির হাত ধরে ফুচকাওয়ালা মামার সামনে গিয়ে হাজির হওয়া ,"ঝাল কম-ঝাল বেশি - আরেকটু টক লাগবে"এই কথা গুলো এখনও কানে বাজে হুটহাট। কত হাজারো রঙিন স্মৃতি। আমার কাছে জীবন মানেই একরাশি রঙিন স্মৃতি।

  • এই যাহ ,চা টা একদম ঠান্ডা হয়ে গেল!
    আর ইচ্ছে হলো না উঠে যেতে। বসে রইলাম বারান্দার বাইরে হঠাৎ চোখ দুটো আটকে গেলো সোডিয়াম আলোর ল্যাম্পপোস্টে। কি রহস্যময় আলো! ওই আলোতে কেনো যেনো মনে হলো আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমার রঙিন কৈশোর ছাড়িয়ে বড়ো হয়ে ওঠা , দায়িত্ব নিতে শেখা ,পরিবারের প্রতিটা মানুষকে বুঝার চেষ্টা। দেখতে দেখতে হুট করেই একদিন বড়ো হয়ে গেলাম। বিশাল কোনো উপন্যাসে যদি মানুষ একটু আনন্দ খুঁজে পায় তবে কখন যে সে বিশাল উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে যায় টেরই পাওয়া যায় না। ঠিক তেমন এত আনন্দে কাটানো আমার ছোটবেলার প্রতিটা দিন কখন যে শেষ হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। কর্মব্যস্ততা,তাড়াহুড়ো,স্বপ্নপূরণ এইসবে ব্যাস্ত থাকা এই শহরের যন্ত্রমানব গুলো হয়তো বুঝতেই পারে না কখন তারা জীবনের একদম শেষ সময়টায় এসে দাড়িয়ে পড়ে।

আমার তাই সবসময় মনে হয় সবকিছুর শেষে নিজের জন্য একটু সময় সবার রাখা উচিত। নিজের ভেতরকার অনুভূতিগুলো একদম চুপচাপ কান পেতে শোনাটা খুব দরকার। সারাদিন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকা টুকরো টুকরো কথাগুলো একটা ডায়েরিতে সাজিয়ে রাখাটাও ভীষণ প্রয়োজন। যাতে এই ধুলোবালির পৃথিবীতে নিজেকে সান্তনা দেয়ার মত ,পাথর আর অনুভূতিশূন্য মনে একটুখানি হাসির ছটা দেয়ার মত কিছু হলেও থাকে।

নিজের সাথে নিজের কথা বলার মত আনন্দের অনুভূতি হয়তো আর একটাও হয় না। এতে সারাদিনের চেপে রাখা রাগ অভিমান দুঃখ আর কষ্টগুলো সরে গিয়ে সেখানে ঠাই পায় আনন্দেরা। রঙিন প্রজাপতির মতো আসে পাশে ঘুরে বেড়ায় আমার সমস্ত সুন্দর স্মৃতিগুলো। একটা তৃপ্তি খুঁজে পাই তখন নিজের মধ্যে আমি ,একটা আত্মিক শান্তি কাজ করে ভেতরে। সব অবসাদ,বিষন্নতা ভুলে গিয়ে নতুন একটা আমিকে আমি দেখতে পাই আমার মধ্যে।

অতীত স্মৃতি যত কষ্টের হয় তত নিজেকে বুঝাতে পারি যে আমি কতটা সক্ষম এখন , কতটা শক্তিশালী এখন। কতটা সুন্দর আমি আমার মধ্যে,আমার নিজের জন্য। আমার তাই মনে হয় স্মৃতি কষ্টের হোক কিংবা আনন্দের,সব স্মৃতি সুন্দর,ভীষণ রকমের সুন্দর।

সময় কিভাবে চলে যায় একদম বুঝি না। নিজের সাথে গল্পের আসর যখন জুড়ে দেই তখন আর কিছুই মনে থাকে না। মনে হয় সময় টা বুঝি থমকে গেছে আজ ওই অন্ধকার আকাশটার মত। তারাদের মত মিটিমিটি হাসি দিয়ে সময়ও আজ শামিল হয়েছে আমার গল্পের আসরে। ভাবতেই কেমন অদ্ভুত এক খুশি কাজ করে ভেতরে।

ঐতো,রাতের আধার বিলীন হয়ে আস্তে আস্তে ভোরের আলো ঠাই করে নিচ্ছে ওই বিশাল আকাশটায়। পাখির কিচিরমিচির শব্দ আজ এত মিষ্টি লাগছে শুনছে!ঐযে,আযানের ধ্বনিও ভেসে আসছে দূর থেকে। আবারও আরেকটা দিনের শুরু। কিছুক্ষন বাদেই নিজের সবটুকু আলো নিয়ে সূর্যটা উপস্থিত হবে আকাশের গায়ে হাজিরা দিতে। আবারও ঘুম থেকে জেগে উঠবে এই বাতি নেভানো বিল্ডিং এ থাকা মানুষগুলো। শুরু হবে ব্যস্ততা,মানুষের কোলাহল, কাজ সেরে বাড়ি ফেরার তাড়না।

আজকে তবে এখানেই ইতি টানি আমার গল্পের আসরের। আমার সমস্ত স্মৃতিরাও এখন পারি জমাবে তাদের বাড়ি। আবারও যখন নিজের কাছে আসব আমি ,নিজের জন্য কথা সাজাবো একা এই শান্ত বারান্দাটায় বসে তখন আবারও ওরা আসবে আমি জানি। আবারও বিরাট একটা আনন্দের মিছিলে যোগ দিব, আরো একবার নতুন করে নিজেকে ভালোবাসবো ,আরো একবার আগের স্মৃতিগুলোতে নিজেকে ভাসাবো।