আজকে ছাত্রীকে ছুটি দিয়ে দিলাম তাড়াতাড়ি। তাড়াহুড়ো করে হাতঘড়ি টা হাতে তুলে নিয়ে ছাত্রীর বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আজ ছাতাটা আনতে একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আকাশ যেরকম কালো হয়ে আসছে, আজকে বৃষ্টি ভেজা দারকাক হয়েই বাড়ি ফেরা লাগবে মনে হচ্ছে। সেই সকালে মায়ের হাতে এক টুকরো রুটি খেয়ে ভার্সিটির জন্য বেড়িয়েছিলাম, টিউশন এ গিয়ে আধা গ্লাস পানি। পেটে একদম কিচ্ছু নেই বলা চলে। বাড়ি ফেরার তাড়ার সাথে খিদে টাও মনে হচ্ছে একদম মাথায় উঠেছে। কি এক যন্ত্রণা।
বাড়ি মাত্র দশ বারো মিনিটের পথ। তাই আর রিকশা নিলাম না। পায়ে হেঁটে রওনা হলাম। মাঝ রাস্তায় না আসতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। প্রথম কয়েক সেকেন্ড একটা বিরক্তি কাজ করেছিল, পরে সব শীতল,কোমল আর সুন্দর। আমি যেখানটায় ছিলাম চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম। ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার মত কিছু ছিল না সাথে। তাই আর রাস্তার বাকি মানুষগুলোর মত এদিক সেদিক দৌড়ে ছাউনির নিচে দাড়াতে হলো না আমার। এত ক্লান্তি, দুপুরের কড়া রোদ হঠাৎ করেই কেমন দমে গেলো। সব বাতাসে মিলিয়ে গেলো। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা আমার চোখ, মুখ, কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছিল। ভেতরে একটা আলাদা রকমের ভালো লাগা কাজ করছিল খুব। সেই একটা জায়গায় ঠায় দাড়িয়ে আছি। কোনদিকে আর চোখ পড়ছে না। চোখ দুটো বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম চুপচাপ।
বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে আমার ভেতরকার সমস্ত শিরা উপশিরা মেতে উঠেছিল। আমি অনুভবে খুঁজে পাচ্ছিলাম আমার সেই পাঁচ বছরের ছেলেবেলা। সেই সময়টায় ঠিক এমন করেই একদিন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলাম তখন। হঠাৎ এই বৃষ্টির আগমন যেনো পাগল করে তুলেছিল আমায়। এক দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে বায়না ধরলাম বৃষ্টিতে ভিজবো। প্রথমে একটু বকা শুনতে হয়েছিল ঠিকই কিন্তু আমার এই নাছোড়বান্দা স্বভাবের কাছে হেরে গিয়ে মা অনুমতি দিয়েছিল সেদিন। ছাদে গিয়ে খুব করে ভিজেছিলাম। সেই যে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দের প্রেমে পড়েছিলাম, এখনো ঠিক তেমনটাই। একটুও বদলায় নি আমার ভেতরের অনুভূতিগুলো বৃষ্টির জন্য।
আমি একটানা হতে থাকা এই ঝুম বৃষ্টিতে আরো খুঁজে পেয়েছিলাম আমার স্কুল জীবনের রঙিন স্মৃতি। খুব মনে পড়ছিল, আজাদ স্যারের ম্যাথ ক্লাস টা ফাঁকি দিয়ে স্কুলের মাঠে সেদিন আমি আর আমার তিন চারজন বান্ধুবি খুব করে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। পরে পিটি মিসের হাতে ধরা খেয়ে কি বকাটাই না খেয়েছিলাম সবাই! এখনো খুব হাসি পায় মনে পড়লে। চোখ বন্ধ করেই আমি হাসছিলাম আমার সব রঙিন স্মৃতির ভিড়ে। জানি আজ আমাকে দেখে লোকে পাগল বলতে বাদ দেবে না কিন্তু তার জন্য তো আমার অনুভূতিগুলোকে আমি এই বৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করতে পারি না!
আবারও ডুব দিলাম কোথায় যেনো। স্পষ্ট দেখতে পেলাম...স্কুল ছুটির ঘন্টা বাজছে, কানে আসছে সেই শব্দ। আমি আর তমা একছুটে স্কুল গেটের বাইরে এলাম। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হচ্ছে ঠিক আজকের মত। আমাদের সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। তমার ছাতার নিচে দুইজন একসাথে দাড়িয়ে ফুচকাওয়ালা মামাকে বললাম এক প্লেট ফুচকা দিতে। এই বৃষ্টির মধ্যে মন ভরে ঝাল দিয়ে এক প্লেট ফুচকা! এর চেয়ে দারুন কিছু আমাদের জন্য আর ছিল না একটাও পুরো দুনিয়াতে! আমি আগে তমাকে খাইয়ে দিলাম। এরপর ও আমাকে। এইভাবে বৃষ্টিতে অর্ধেক ভিজে আর অর্ধেক ছাতার নিচে দাড়িয়ে সেদিন ফুচকা খেয়েছিলাম আমরা। এখনো সেই কথা মনে করে দুই বান্ধুবী হাসিতে ফেটে পড়ি।
বৃষ্টির ঠান্ডা ছোঁয়া, মাতাল করা শীতল বাতাস, শো শো শব্দ, বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দ.....সব মিলিয়ে কোথায় যে ডুবে গিয়েছিলাম আমি, মনে করা টা কঠিন। শুধু আমি না, আমার সাথে সেদিন ডুব দিয়েছিল আমার সমস্ত অনুভূতি, সব সুখ, সব রঙিন স্মৃতি। বৃষ্টিতে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয় তা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। এরচেয়ে সুন্দর আর কিচ্ছু হয় না। যখন ই আমি বৃষ্টির নাগাল পাই আমার ভেজা লাগবেই যে করেই হোক। এরজন্য কত জর আর কাশিতে ভুগেছি তার হিসেব নেই। ভেতরকার সমস্ত কষ্ট, ক্লান্তি, চাপ সবকিছু চাপিয়ে বিরাট বড়ো করে রংধনু উঠেছে এমন মনে হচ্ছিল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। কখন যে ঘন্টা পেরিয়ে গেলো হিসাব ই ছিল না। ব্যাগে পলিথিন মোড়ানো ফোনটায় মায়ের দেয়া কতগুলো কল উঠলো। আমি কানেই তুললাম না। এত শান্তি ছেড়ে অন্য কিছুতে মন দিতে ইচ্ছে হয় এত সহজে? আমি নিশ্চিত আজ বাড়ি ফিরে সেই বারো বছরের মেয়েটার মত বকা শুনতে হবে আবার।
ঠিক এমনি একটা বৃষ্টির দিনে, তখন আমার বয়স বারো। এত ভিজেছিলাম সেদিন। বাড়ি ফিরতেই শরীর টা কেমন গরম লাগছিলো। টানা এক সপ্তাহ ভুগেছিলাম জ্বরে। সে কি বকুনি আমার মায়ের। কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গিয়েছিল বেচারি। কতো কতো স্মৃতির পাতা উল্টালাম এই এক দেড় ঘণ্টায় তার হিসাব নেই। বৃষ্টি এলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। বৃষ্টি এলেই মনে হয় আমি আর আমার মধ্যেই থাকি না, হারিয়ে যাই অন্য একটা দুনিয়ায় যেখানে আমার অনুভূতির ঝড় ওঠে, ভেতরের সব আনন্দেরা গান গেয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে বৃষ্টির তেজ কমে এলো। ভেজা শরীর টা নিয়ে হাজির হলাম মায়ের সামনে। মা বলে উঠলো.......
- এত বড় মেয়ে, এখনো যদি এইভাবে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরিস, তাহলে হবে?
ওই ভেজা শরীর নিয়েই মা কে জড়িয়ে ধরলাম। মনে মনে ভাবলাম সেই পাঁচ বছরের মেয়েটাকে বৃষ্টিতে ভেজার অনুমতি না দিলে আজ সে জানতোই না পৃথিবীটা এত সুন্দর।
বাড়ি ফেরার কথা ছিল তিনটার মধ্যে। সেই আমি বাড়ি ফিরেছি বিকাল পাঁচটায়। মাকে আর থামালাম না। বকুনি শুনতে শুনতেই নাওয়া, খাওয়া সেরে নিলাম। তারপর আমার রুম এ জানালার কাছে দাড়িয়ে দেখলাম কি সুন্দর রংধনু। ঐযে আমার ভেতরে বড় করে উঠেছিল একটা রংধনু, সেটাই। আমার অনুভূতি আজ বৃষ্টিস্নান সেরে এত সুন্দর একটা রংধনু ফুটিয়ে তুলেছে আকাশে।
Congratulations @farzanaakter! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s) :
Your next target is to reach 100 posts.
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP
To support your work, I also upvoted your post!
Check out the last post from @hivebuzz: