কিছু জিনিস আপনি রাস্তায় না নামলে দেখবেন না, বুঝবেন না, শুনবেন না, জানবেন না।
আমরের সাথে গতরাতে তুমুল তর্ক, আমি খোঁড়া পা নিয়াই আন্দলোনে যাবো, তার যুক্তি আন্দোলনে যাবার জন্য রাস্তায় নামা জরুরি না। আমি ভালো লেখি, আমার লেখাও কন্ট্রিবিউট করবে, অন্তত সুস্থ থাকলে একটা কথা ছিলো।
কিন্তু ৩৩শে জুলায়ের (২ আগস্ট) মিছিলে যাবার পথে বাইক এক্সিডেন্ট করার কারণে, এত আয়োজন করেও যাওয়া ক্যান্সেল হওয়ায় আমি আজকে বদ্ধপরিকর আমি যাবোই। খোঁড়ায়ে খোঁড়ায়ে হইলেও।
শহীদ মিনার যাইতেই হবে আজ, ৩৪শে জুলায়ে (৩ আগস্ট)।
আমার এই একগুঁয়েমি'র কারণ আছে। কারণ আমি আগেরদিনগুলায় যেয়ে উপলব্ধি করেছি আন্দোলনের কিছু গল্প কেবল আপনি ওখানে থেকেই শুনবেন, দেখবেন, জানবেন। আজকের গণজাগরণের মত গুরুত্বপূর্ণ দিন তাই মিস করতে চাইনাই। অগ্যতা আমর আমার সঙ্গে চললো।
অনেক শুনছি, দেখছি রাস্তায় নিম্নবিত্ত লোকেদের জেসচারগুলা'র বিষয়ে, কিন্তু নিজে যখন সেইগুলা এক্সপেরিয়েন্স করলাম, সেইগুলার ভাবাবেগই অন্যরকম ছিলো।
"ফুটেজ খাবার তাল সবই, কারণ আজকাল সবাই খালি ভাইরাল হইতে চায়" এরকম ভাবছিলাম।
এবং আমার ওদেরকে অতিরঞ্জিতই মনে হচ্ছিলো।
কিন্তু এই ধারণা এই রাস্তায়-নামা শুধু বদলায়ে দেয়নি, অবাক করেছে বহুগুণ।
সবাই এরকম না অবশ্য, তবে এই যে "কতিপয় কিছু" এরাই আসলে বদলটা আনে। সব সিএঞ্জি/রিকশাওয়ালা, সব পেয়ারা/পানি বিক্রেতা কিন্তু এরকম না, বরং অনেকেও এর মাঝে ধান্দায় থাকে ভাড়া বেশী বাগিয়ে নেবার, চা/পানি চড়া মূল্যে বিক্রি করার, কিন্তু আমরা অই "ছোট্ট বদলটাকে"ই দেখি, ওটাকে ধরেই নাড়া দিবাকিরা হয় লাইনে আসে নাইলে ছিটকে যায়।
কিছু জিনিস আপনি রাস্তায় না নামলে দেখবেন না, বুঝবেন না, শুনবেন না, জানবেন না।
যেমন এক সিএনজি মামা " শহীদ মিনার যাবো" শুনতেই সাফ মানা। তার সামনের জন বলে "আসেন আমি যাবো।"
প্রথম জন, "অই ব্যাডা, তুই যাবি কেম্নে হুদা মাতছ। এইডা পুরা জাম আর ব্লক"
২য় জন বলেঃ "যদ্দুর পারি যামু, যতদূর যাওন যায় আগায়া দিয়া আমুনে, মামা আপনি ওডেন"
ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে "যা ইচ্ছা দিয়েন"
সিএনজিওয়ালাদের আমি স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করিনা, অন্তত এই কথা যারা বলে তাদেরতো নাই-ই। কিন্তু তার এক কথা, "যা ইচ্ছা দিয়েন, আচ্ছা ৫০টাকা দিয়েন যান!
আমি ভাবলাম আচ্ছা দিবো আরকি ২শ। একদিকে বন্ধ হইলে ঘুরে আরেকদিকে যান কিন্তু মাঝরাস্তায় নামায়ে দেয়নাই। কথা রেখেছেন। ভদ্রলোক যেনো বদ্ধপরিকর যে শহীদ মিনারে তিনি পৌঁছাবেনই!
৫ কিলো রাস্তা, প্রায় ১০/১২ কিলো এক্সট্রা ঘুরে ঘুরে আমাদের নিয়ে গেলেন। এবং বেশ জোর করেই তাকে ১২০টাকা দিয়ে এলাম।
শাহবাগ নামতেই রিকশাওয়ালা মামা চেঁচিয়ে ওঠে " শহীদ মিনার না মামা? এদিকে আসেন"
ভাড়া?
আরে ওডেন আগে, ভাড়া দেখা যাইবোনে। খুচরা ছিলোনা, ৩০টাকা দিলাম।
আকাশ কাঁপিয়ে চিল্লায়ে গলা কাহিল। পানি কিনতে গেলে উনিও খুচরা নাই বলে পানির বোতল ফেরত দিচ্ছিলাম, পাশ দিয়ে মধ্যবয়স্কা একজন আন্টি বলে "পানি খাবা? এই ওরে পানি দাও, কতটাকা আমারে বলো, আমি দিচ্ছি!"
ভদ্রমহিলা কালো বোরখা পরিহিতা, একটা সুতির ওড়না পেঁচিয়ে এসেছেন। উনি ছিলেন আমাদের প্রচন্ড রক্ষণশীল, ওভারলি স্নেহপরায়ণ মা'দের প্রতিচ্ছবি, যারা আন্দোলোনে যাবেন না এবং যেতেও দেয়ার কথানা।
তাই ওনাকে দেখে অবাকই হলাম।
এর মাঝে কিছু বাবা-মা তাদের ৮/১০/১২ বছরের বাচ্চাদেরকেও এমনকি নিয়ে এসেছে! ওদের সাথে নিয়ে উত্তাল জনসমুদ্রের মাঝে গরমে, ঘামে, যে বাচ্চাদের দেখে বুঝা যায় ওরা কত ওভার-প্রটেকটিভভাবে, আদরে আহ্লাদে বড় হয়েছে, এসি না থাকলেও অন্তত গ্রীষ্মের দাবদাহে যারা কষ্ট পায়নি, সেই বাচ্চাদের সাথে নিয়ে মা-বাবা'রা গলা খুলে স্লোগান দিচ্ছে "রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়!"
এই উত্তাল জন সমুদ্রের মাঝে, যেখানে গরমে অতিষ্ট, ঘামছে দরদর করে, উপভোগ করবার মতো কোনো সার্কাস নেই, মেলা নেই, কেবল মানুষের গগণবিদারি স্লোগান যার মর্ম তারা বোঝেনা, তবুও ওদের সব কটাকে দেখলাম বেশ আনন্দেই আছে, খুব উপভোগ করছে।
আমরের সাথে এই তর্কে সেদিন আমি ওকে বলতে পারিনি কেনো বিষম পা ব্যথা নিয়েও, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, শারীরিক ব্যথা নিয়েও আমাকে মিছিলে যেতেই হবে। এজন্যই আমি এত উন্মুখ।
আমার গল্পটা আমি শুধু লোকমুখে শুনে না, গল্পের প্লটের মধ্যিখানে থেকে, দেখে, বুঝে, জেনে লিখতে চাই।
কিছু জিনিস আপনি রাস্তায় না নামলে দেখবেন না, বুঝবেন না, শুনবেন না, জানবেন না।
34th July (3rd August), 2024.
Stories of a of a July that has not ended after 31st!
All the contents are mine, until mentioned otherwise.