বেহালা রহস্য

in BDCommunity3 years ago

010FD78E-C4BC-4565-8ED8-7D7ED07BC9CC.jpeg

ঘড়িতে দুপুর ২ টা বেজে ১৭ মিনিট। আলো অন্ধকার মিশেল একটি কক্ষে আঁখি উৎকণ্ঠা এবং উত্তেজনায় ক্রমাগত ঘামছে। এর অন্যতম কারণ-এই এলইডি বাতির যুগে জানালাহীন কক্ষের এক কোণে প্রায় লুপ্ত হতে যাওয়া ভলুমেট্রিক সেইপ এর একটি ৬০ পাওয়ারের বাতি বাদামী আলো ছড়াচ্ছে। তার ঠিক মাথার উপর দেয়াল থেকে লম্বা রড দিয়ে ঝুলতে থাকা একটি পুরনো ফ্যান ঘরঘর শব্দে ঘুরছে। এই পাখাটি বাতাস দিচ্ছে কিনা আঁখি সেটা বুঝতে পারছে না কারণ তার সারা শরীর এবং পরিধেয় কাপড় ঘামে ভিজে যাচ্ছে। ঘরের এই গুমোট আবহাওয়া এবং নিকোটিন মিসৃত ধোঁয়ায় তার রীতিমতো শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

এটিই দেশের খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী সোবহান সাহেবের স্টাডি রুম। তিনি বিগত ১৫ মিনিটে দুটি সিগারেট শেষ করে তৃতীয়বারের মতো সিগারেট ধরিয়ে আঁখির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে এই প্রথমবারের মত কথা বললেন।

—তুমিই তাহলে কানাডা থেকে আমাকে চিঠি লিখেছিলে?
—জি, আপনি তো ফোন ব্যবহার করেন না; তাই লিখতে বাধ্য হয়েছি।
—চিঠিতে তুমি বিশেষ কিছু লিখনি, সাক্ষাতে কথা বলতে চেয়েছিলে, বল কি বলতে চাও?
—আমার বাবা গত মাসে ফাঁসি দিয়ে মারা গেছেন!

সুবাহান সাহেব সিগারেটে লম্বা আরেকটি টান দিয়ে আঁখির দিকে না তাকিয়েই বললেন—

—তোমারতো পুলিশ বা ডিটেকটিভ এর কাছে যাওয়ার কথা, আমার কাছে কেন এসেছ?
—বিষয়টা একটু অন্যরকম, ওরা এর সমাধান করতে পারবে না!

আঁখি সুবহান সাহেবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘটনার বর্ণনা শুরু করলো—

আমি তখন বেশ ছোট, অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের যৌথ পরিবার ছিল। আমি প্রায়ই দেখতাম আম্মু আর দাদির মধ্যে মনোমালিন্য লেগেই থাকত। বিষয়টা নিয়ে বাবা মনে মনে বেশ কষ্ট পেতেন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল এবং বাবা যখন দাদি আর মায়ের পক্ষ নির্বাচনে উভয় সংকটে, তখন তিনি তার পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

অনেক নিষেধ করা সত্ত্বেও বাবা বেশ অল্প দামে আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজনের কাছ থেকে একটি একতলা ভবন সহ বাড়ি কিনে নেন। সবাই বাবাকে নিষেধ করার কারন ছিল ওই বাড়ির ছাদে নাকি প্রায়ই একজনকে নববধূর সাজে বেহালা বাজাতে দেখা যায়।

আমার বাবা একজন নাস্তিক এবং বেশ সাহসী মানুষ ছিলেন। তাই তিনি এই সব কথায় কান না দিয়ে ওই বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই প্রথম আমার মা এর সাথে বাবার মতের অমিল হলো। মা কিছুতেই ওই বাড়িতে যেতে রাজি হননি, তিনি চেয়েছিলেন আমাদেরকে নিয়ে তার নিজের বাড়িতে উঠতে। কিন্তু বাবা তাতে রাজি হলেন না। অগত্যা আমি আর মা ঢাকার কাঁঠালবাগানে আমাদের নানুবাড়িতে চলে আসি আর বাবা ওই বাড়িতেই থেকে যান।

বাবা প্রায়ই আমাকে দেখতে আসতেন। কিছুক্ষণ এলোমেলো দৃষ্টিতে আমাকে দেখে তারপর চলে যেতেন। পরবর্তীতে আমি মনোবিজ্ঞানে স্কলারশিপ নিয়ে কানাডা চলে যাই। তারপর দীর্ঘদিন বাবার সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি; তবে মার কাছ থেকে জানতে পারি বাবা দিনের বেশিরভাগ সময়ই ওই বাড়িতে থাকতেন, কারো সাথে তেমন কোনো কথাবার্তা বলতেন না।

এখন হয়তো আপনার মনে হতে পারে আমি একজন মনোবিজ্ঞানী হয়েও কেন এইসব অলৌকিক গল্প আপনার কাছে বলছি। যেই রাতে বাবা ফাঁসি নেন সেই রাতেও ওই বাড়ির ছাদে দীর্ঘক্ষণ বেহালা বাঁজতে শোনা যায়। আর আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি; ওই একই বাড়িতে একটি মেয়ে নববধূর সাজে ওই একই কক্ষে ফাঁসি দিয়ে মারা যায় এবং সেটা আমার জন্মেরও আগে।

আরও দুটি তথ্য আপনাকে দিয়ে রাখি। প্রথমত পোস্টমর্টেমে বাবার মৃত্যু শ্বাস রোধ জনিত কারণে হয়েছে এমন রিপোর্ট আসে। কিন্তু ঘরের দরজা খুলে তাকে ঘরের ছাদ বরাবর শূন্যে ঝুলে থাকতে দেখা যায়; কোন ফাঁসির দড়ি সেখানে পাওয়া যায়নি। ঠিক তার কিছুক্ষণ পরে মৃতদেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখা যায়। দ্বিতীয়তঃ যখন তার মৃতদেহ ঝুলছিল তখন তার ডান কাঁধে বেহালা ছিল এবং তিনি সেটা বাজানোর ভঙ্গিমায় ছেলে। আমার বাবা মিউজিক খুবই অপছন্দ করতেন। সুতরাং আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তাই এ অবস্থায় আপনার দ্বারস্থ হয়েছি।

সোবহান সাহেবের টাক মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। তিনি আর একটি সিগারেট দেশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে আঁখিকে বলতে লাগলেন—

—তুমি বেহালাটি নিশ্চয়ই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছো?
—জি এনেছি।
—ওটা রেখে যাও।
—তুমি ঠিক এক সপ্তাহ পরে আবার আসবে।

আঁখি ঘর থেকে প্রায় বের হয়ে যাচ্ছিলো কি মনে করে আবার পেছন ফিরে তাকালো এবং সোবহান সাহেবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল—

আপনাকে দেখে কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি ঘটনাটি ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি। আমি নিজেও একজন মনোবিজ্ঞানী আর শক্ত মনের মানুষ। গতরাত্রে আমি ওই বাড়িতে সারারাত ছিলাম এবং রাতের বেলায় বেহালা বাজানোর শব্দ আমি নিজেও শুনেছি, এটা হচ্ছে তার রেকর্ডিং। আঁখি টেবিলের উপরে পেন ড্রাইভটা রেখে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। সুবহান সাহেব সিগারেটে আরেকটি লম্বা টান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে নিজেই বলতে লাগলেন, আরেকটি ব্যস্ত সপ্তাহ পার করতে হবে; প্রস্তুত হও-

আঁখির বাবার মৃত্যু রহস্য পর্যালোচনায় আজ অষ্টম দিন।
সুবহান সাহেব একগুচ্ছ প্লাস্টিকের দড়ি হাতে একটি কাঠের চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘড়িতে রাত্র ১১ টা বেজে ৫৫ মিনিট। আগামী ৫ মিনিটের ভিতরে তাকে কাজটা সারতে হবে। বিগত তিন মিনিটের চেষ্টায় সে ফাঁসির নট টা বাঁধতে সমর্থ হয়েছে, এখন শুধু ঝুলে পড়াটা বাকি।চারিদিক থেকে মধুর স্বরে বেহালার শব্দ ভেসে আসছে। এ যেন এক অপার্থিব অনুভূতি। এমন এক অপূর্ব এবং অপার্থিব পরিবেশে মরতে পারাটাও এক সৌভাগ্যের ব্যাপার। সুবহান সাহেব আস্তে করে পায়ের নিচের চেয়ারটা সরিয়ে দিল এবং ফাঁসিতে ঝুলে পড়ল। ফাঁসিতে ঝুলা সত্বেও তার মৃত্যু হল না, কাজের বুয়ার তীব্র ঝাড়ু দেয়ার শব্দে তার দিবাস্বপ্নের অবসান হলো!

সুবহান সাহেব চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে তার স্টাডি রুমে এসে একটি সিগারেট ধরালেন। তার মুখ ভাবলেশহীন, কেউ দেখলে বুঝতে পারবে না যে একটু আগে সে একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছে। একটু পরেই আঁখি আসবে। তিনি সিগারেটে আরেকটি লম্বা টান দিয়ে মনে মনে বিগত এক সপ্তাহের ঘটনাবলীকে সাজিয়ে নিলেন। আঁখির পায়ের শব্দে তার ধ্যান ভঙ্গ হলো। তিনি চোখ না খুলেই আঁখিকে বসতে বললেন।

—তুমি কি সত্যিই তোমার বাবার মৃত্যুর রহস্য জানতে চাও?
—হ্যাঁ চাই।
—আসল ঘটনা টা জানার পরে তোমার মনে হতে পারে ঘটনাটা বোধহয় না জানলেই ভাল হত।
—তেমন সম্ভাবনা নেই, আমি সবকিছুর জন্য প্রস্তুত, আপনি বলুন।
—তোমার বাবা আত্মহত্যা করেননি, আমার ধারণা উনাকে হত্যা করা হয়েছে।

সুবহান সাহেব আঁখিকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ না দিয়েই তার বিগত সাত দিনের ঘটনা বলতে লাগলেন—

তোমার সাথে কথা হওয়ার পরে আমি তোমাদের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। যে নববধূ বিয়ের রাতে ফাঁসি দিয়ে মারা যায় তার সম্পর্কে খোঁজখবর করি। ইউনিভারসিটিতে পড়াকালীন সময়ে সে এবং তার খুব ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবী বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে বেহালা বাজানো শেখে। সেই সময়ে সে তার এক ইউনিভার্সিটির সিনিয়রের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সম্পর্কটা প্রেমকে ছাপিয়ে উৎকণ্ঠায় পরিণত হয় তখনই যখন মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়ে যায়।
পরিবারের পক্ষ থেকে বিধর্মী এক ছেলের সাথে মেয়েটির সম্পর্ক আছে জানতে পেরে এক রাতের মধ্যে পাত্র জোগার করে সেই মেয়েটির বিয়ে ঠিক করা হয়। মেয়েটি সেই রাতেই বিয়ের আসর থেকে উঠে গিয়ে ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করে।

তোমার দৃষ্টি বলে দিচ্ছে যে তুমি বেশ বুঝতে পারছ ঐ লোকটি কে ছিলেন। হ্যাঁ, উনি ছিলেন তোমার বাবা। আর তোমার মা ছিলেন ওই মেয়েটির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। তোমার মা সবকিছু জেনেই তোমার বাবাকে বিয়ে করেন, কিন্তু প্রেগনেন্সি এর বিষয়টা জানতেন না। তোমার মায়ের ধারণা ছিল সময়ের সাথে সাথে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে এবং ঠিক হয়েও গিয়েছিল। কিন্তু তোমার বাবার ঐ বাড়িটা কেনা এবং ওইখানে থাকার পর থেকে তোমার মায়ের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ এবং জেদ তৈরি হয়। উনি তোমার বাবার ডায়েরি ঘাটতে শুরু করেন। ডায়েরি পড়ার পর তোমার মা তার বান্ধবীর প্রেগনেন্সি এর ব্যাপারটা জানতে পেরে যান।

ডায়েরি পড়া মাত্র তোমার মা প্রচন্ড রাগে এবং ক্ষোভে তোমার বাবার কাছে ছুটে যান। ঝগড়ার এক পর্যায়ে তোমার মায়ের ধাক্কায় ঘাড়ের সংবেদনশীল জায়গায় আঘাত পেয়ে তৎক্ষণাৎ তোমার বাবা মারা যান। ভয় পেয়ে তোমার মা তোমার পুলিশ অফিসার মামাকে ডেকে এনে বেহালা এবং এই ফাঁসির ঘটনাটা মঞ্চায়ন করেন।

—বাবার ফাঁসি দেয়া মৃতদেহটা তাহলে শূন্যে ঝুলে ছিল কেন?
—তোমার কাছে এই প্রশ্নটা আমি প্রত্যাশা করি নি!

কানাডাতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য এক ধরনের অদৃশ্য কাপড়ের তৈরি পোশাক ব্যবহার করে থাকেন। মজা করা এবং তোমার মাকে চমকে দেয়ার জন্য তুমি সেখান থেকে তোমার মাকে এক টুকরো অদৃশ্য কাপড় পাঠিয়েছিলে। তোমার বাবাকে ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য সেই কাপড় ব্যবহার করা হয়েছিল। আর শূন্যে থেকে লাশটা পড়ে যাওয়া একটি কাকতালীয় ব্যাপার। পরবর্তীতে কৌশলে তোমার মা সেখান থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলেন।

তোমার পরবর্তী প্রশ্নের উত্তরটা আমি আগে থেকেই দিয়ে দেই। সেই রাতে তোমাকে কনফিউজ করার জন্য এবং বিষয়টা নিয়ে না আগানোর জন্য তোমার মা ওই ছাদে বসে বেহালা বাজাচ্ছিলেন।

একজোড়া অবিশ্বাস্য ছলছলে চোখ সোবহান সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। সোবহান সাহেবের ভিতরে মায়া মমতা বোধ খুব কম তারপরেও আঁখিকে দেখে কেন জানি খুব মায়া হচ্ছে। একটা কথা আঁখিকে বলা হয়নি। যেই রাতে সে ওই বাড়িতে ছিল সেদিন সেও বেহালার শব্দ শুনতে পেয়েছে। বেহালার সুর তার খুব প্রিয়। সে জীবনে অনেক বিখ্যাত বেহালা বাদক এর বাজানো শুনেছে। সে নিশ্চিত এমন বেহালা কোন পার্থিব মানুষের পক্ষে বাজানো সম্ভব নয়।

তাহলে কে বাজাচ্ছিল এমন অপার্থিব সুর? সে আর ভাবতে চাইছে না, কারণ সে একজন যুক্তিবাদী মানুষ। অলৌকিক কিছুর স্থান তার কাছে নেই।
Image Source

Sort:  

হুমায়ুন আহমেদ এর মতো লাগলো! বেশ ভালো!

khub valo legeche

আপনার লেখার ধরন খুব ভালো। এগিয়ে যান । ধন্যবাদ

You are most welcome.

Congratulations @deepu7! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s) :

You made more than 1500 comments.
Your next target is to reach 2000 comments.

You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word STOP