সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পঞ্চাশ দশকের পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যে অন্যতম।
৫০ দশক বাংলা সাহিত্যের জন্য এক উর্বর সময়.. এই সময় দুই বাংলায় অসাধারণ কিছু কবি আধুনিক বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং কবিতার বিনির্মাণের জন্য প্রয়াসী ছিলেন.. এর মধ্যে প্রধানতম কয়েকজন হলেন- বাংলাদেশের কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ... আর পশ্চিমবঙ্গের দুই কিংবদন্তি কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে এর আগেও লিখেছি মেধার অপচয় নিয়ে.. তিনি এত বেশি লিখেছেন যে- তার প্রচুর লেখার আড়ালে অনেক ভালো লেখা ঢাকা পড়ে গেছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে যে কবিতাটির কথা সবার মনে আসে.. কেউ কথা রাখেনি.. এই কবিতাটি আসলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সিগনেচার পোয়েট্রি বলা যায়।
কবিতাটি ছোট ছোট কয়েকটি ঘটনার ধারাবাহিক সিরিয়াল.. এ ঘটনাগুলো একটি সূত্রে মিলিত হয়.. সেটি হল- কথা না রাখা। পাঠক যখন কবিতাটি পড়ে, তখন সেও সেই ঘটনাগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। কারণ আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই শৈশবে এমন কিছু ঘটনা থাকে.. না পাওয়ার বেদনা থাকে.. যেগুলো সারা জীবন আমাদেরকে নস্টালজিক করে রাখে। ফলে এ কবিতাটি যখন পড়ে.. তখন যেন সে নিজেকে খুঁজে পায়.. এবং তার নিজেরও মনে হয়- কেউ কথা রাখেনি..
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো,
কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান
হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো,
কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি..
খুব সাধারন একটি ঘটনা.. এক বোষ্টুমী তার বৈষ্ণব গান অর্ধেক শুনিয়ে চলে গিয়েছিল.. বলেছিল, বাকিটা পরের বার যখন আসবে, তখন শোনাবে.. কিন্তু সে আর আসে নি। যদিও এটি আমাদের প্রাত্যহিক অন্যান্য ঘটনা ও ব্যস্ততায় আড়াল পড়ে যাওয়ার কথা.. কিন্তু শিশু মনে কখনো কখনো এরকম ছোট ঘটনা গুলো দাগ কেটে যায়।
কবির মানেও সে রকম দাগ কেটে গেছে.. তার হঠাৎ করে মনে হল যেন ২৫ বছর আগের সেই গানটির অপেক্ষাতেই তিনি ছিলেন.. কিন্তু বোষ্টুমি আর আসেনি।
কেবল সেই বোষ্টুমি নয়, এক মাঝিও তাকে আশ্বাস দিয়েছিল- তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবে। আমরা অনেক সময় বিভিন্ন রকম প্রবোধ দেই.. যেগুলো ছোটদের মনে গেঁথে যায়।
বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবারা.. তাদের সীমাবদ্ধতা এবং বাস্তবতার কারণে.. অনেক আবদার পূরণ করতে না পেরে.. বাচ্চাদেরকে মিথ্যা প্রবোধ দিতে থাকে। অবোধ শিশুরা প্রবোধ বিশ্বাস করে.. করতে করতে একসময় আবিষ্কার করে- কেউ কথা রাখেনি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস,
একদিন আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স,
সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!
এটা যে কেবল শিশু মানসের সাথে ঘটে, তা কিন্তু নয়! আস্তে আস্তে সে বড় হতে থাকে.. তার বারবার এই অভিজ্ঞতা হতে থাকে.. কখনো প্রেমিকা, কখনো বন্ধু, কখনো সহকর্মী, কখনো সহপাঠী.. কথা রাখেনি।
ভালোবাসার জন্য আমি
হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে
খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা,
এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী।
ব্লগ পুরোটা পড়ে কমেন্ট করবেন। আমার লেখাটা পড়লে এটা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়- যে কবিতাগুলো আমি কোট করেছি, সেগুলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কেউ কথা রাখেনি কবিতার অংশ।