বয়স যখন ছয় ছিলো তখন প্রথম নানাবাড়িতে ঘুরতে আসি। বাবা, মেজো ভাই আর আমি। জন্মের পরে এই প্রথম নানাবাড়িতে যাওয়া। সেই সময়ের কথা যতটুকু মনে পরে সকাল বেলা বাসার সামনে লাল একটা গাড়ি আসছিলো। মেজো ভাই আর আমি পিঠাপিঠি ছিলাম। কে সামনে বসবো এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে জেদ জচ্ছে। এর মধ্যে বাবা এসে আমাদের দুজনকেই সামনে বসায় দিলো। পরে অবশ্য ভাই পিছনে চলে গেছিলো। তখন বড় ভাইকে নানাবাড়িতে পাঠায় দিছিলো। নানাবাড়ি গ্রামে আর ভাইয়া শহরে মেসে থাকতো। যাওয়ার সময় আমরা মেসে ভাইয়ার সাথে দেখা করে যাই। আমার জ্ঞান হবার পরে ভাইয়াকে মনে হয় ওই সময় প্রথম দেখছিলাম। ভাইয়াকে বাবা অনেক আগে থেকেই মেসে রাখছিলো। তখন ভাইয়া ক্লাস নাইনে পরতো। মেসে যাওয়ার পরে মেস মালিক আমাকে আর মেজো ভাইকে ওয়েফার কিনে দিছিলো। আল হেরা একাডেমিতে পড়তো ভাইয়া। ভাইয়ার সাথে দেখা করে আমরা নানির বাড়িতে চলে গেলাম। যাওয়ার পরে শুধু মনে আছে দোতলা একটা বাড়ি আর পাশে টিনের কয়েকটা ঘড়। টিনের ঘড়ে আমরা দুপুরে ভাত খাইছিলাম। তখন বাসাতে নানা, নানি, মেজো খালা আর ছোট খালা থাকতো। পাশেই আর একটা খালার বাড়ি। আমার জন্মের পরে মেজ খালা আর খালা আমাকে প্রথম দেখতেছে। এর আগে যখন মেজো ভাই হয় তখন নাকি ছোট মামা ওকে দেখতে যেয়ে দেখে আমিও হইছি। আগে তো চিঠির যুগ ছিলো। মেজো ভাইয়ের খবর সবাই পাইছিলো। আমার হবার খবর কেউ জানতো না। সেই সময় আমার নানাবাড়ি অনেক ভালো লাগছিলো। এখানে অনেক কাজিন ছিলো। একদিনের জন্যে আসছিলাম এখানে অনেক খেলছিলাম ওদের সাথে। এরপরে প্রায় দুই বছর পরে আমরা একেবারে নানাবাড়িতে চলে আসি। বাবার অবসরের পরে আম্মাকে নানি বলে এখানে থাকতে। কিছুদিন পরে মেজো খালার দেশের বাহিরে চলে যাবে আর ছোট খালার বিয়ে হয়ে যাবে তখন এখানে কেউ থাকবে না। নানা নানি একা হয়ে যাবে এজন্য আম্মাকে বলছিলো এখানে থাকার জন্য। এখানে আসার দিন আমাদের প্রায় রাত হয়ে গেছিলো। আর প্রায় রাত দুটার দিকে আমাদের মালামালের ট্রাক আসছিলো। ঝড় হইছিলো সেদিন অনেক। ট্রাক এতো রাত হইছিলো পরে জানা যায় আমাদের অনেক জিনিস ট্রাকের লোকজন রাস্তায় প্যাকেট খুলে বের করছিলো।
পরেরদিন সকালে প্রথম আমি ছাদে আসি। সেই সময় এই ছাদ বিশাল বড় মনে হতো। সারাদিনে জিনিসপত্র সব গোছানো হলো। তখনও এখানে একবারে চলে আসছি আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। কিন্তু আমার অনেক ভালো লাগছিলো যে কয়েকদিনের জন্য স্কুলে যেতে হবে না। এই কয়েকদিন যে মাত্র দুদিন হবে বুঝিনাই। বাবা আমার মেজো ভাই আর আমাকে নিয়ে এখানের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করায় দিলেন। প্রথম কয়েকদিন আমাদের দুই ভাইকে বাইকে করে স্কুলে দিয়ে আসতেন। এরপরে থেকে চার টাকা করে হাতে দিতেন। যেতে আসতে দুই টাকা আর দুই টাকা খাওয়ার জন্য দিতেন। এর পরে যখন ক্লাস থ্রি থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ক্লাস শুরু হলো তখন টিফিন দিয়ে দিতো সাথে করে। তখন আবার শুধু দুই টাকা দিতো। কারণ টিফিন তো দিয়ে দিচ্ছে এক্সটা টাকা কেনো দিবে। আমার একটা কাজিন আমার ক্লাসে পড়তো। ও আমার থেকে বয়সে দুই বছরের বড় ছিলো। পরে খালা ঠিক করলো ওকে আমার মেজো ভাইয়ের সাথে ক্লাস ফোরে দিবে। আর আমি তখন ক্লাস থ্রি তে। আমারতো প্রচন্ড মেন খারাপ ও চলে গেলে আমি একদম একা হয়ে যাবো। আমি নতুন আসছি নতুন কোন বন্ধু নাই আমার। আমরা একসাথে ক্লাসে বসতাম। খালাকে তখন অনেকবার বলছিলাম ক্লাস থ্রি তে রাখার জন্য কিন্তু পরে সে ক্লাস ফোরে চলে যায়। এরপরে আমার কাজিনের যে ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলো ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়। আমরা সবাই স্কুল শেষে একসাথে বাসায় ফিরতাম। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে কাজিনরা সবাই মিলে ছাদে খেলতাম। সেই সময় সবথেকে বেশি গাড়ি খেলতাম। ছাদের রেলিংয়ে ছোটছোট গাড়ি নিয়ে হাত দিয়ে চালাতাম। তখন আমার ছোট ছোট মেটালের অনেক গাড়ি ছিলো। আর এক বন্ধু আমাকে দুইটা গাড়ি গিফট করছিলো। ওই দুইটা গাড়ি সবথেকে বেশি সুন্দর ছিলো। সবসময় প্যান্টের পকেটে রেখে দিতাম। একদিন টয়লেটে যেয়ে কাজ করার সময় হঠাৎ করে দেখলাম পকেট থেকে বের হয়ে প্যানে পড়ে গেলো। আমি শুধু হা হয়ে তাকায় থাকলাম। আমার সবথেকে সুন্দর গাড়িটা প্যানের ভিতরে চলে গেলো। এই গাড়ির জন্য যে আমার কতদিন মন খারাপ ছিলো। বারবার মনে হত কেনো পকেটে রাখতাম সবসময় গাড়িটা। যদি না রাখতাম তাহলে আমার গাড়িটা নিচে পড়তো না। রেলিং এ গাড়ি খেলার জন্য আমরা রেলিঙের উপরে কতগুলোন স্পিড বেকার করে দিছিলাম। হেটেহেটে গাড়ি নিয়ে এগোতাম আর সাইড বেকার আসলে গাড়ি একদম আস্তে করে নিয়ে যেতাম। কিন্তু আমাদের গাড়ি খেলার আর কিছুদিন পরে হলো না। নানা সারা বছরের খড়ির জন্য বিভিন্ন গাছের ডালপালা কেটে ছাদে শুকাতে দিতো। তখন আর আমরা খেলতে পারতাম না।
একবার নানা ছাদে ইটের খোয়া রাখছিলো। আমি একটা একটা করে নিয়ে নিচের টিনের চালে ফেলতেছিলাম। হঠাৎ দেখি নানা প্রচন্ড রেগে ছাদে আসতেছে আমাকে মারার জন্য। কষ্ট করে ইট ভেঙ্গে ছাদে আনা হইছে আর আমি সব নষ্ট করতেছি। আমি সাথেসাথে দৌড়ায় রুমে যেয়ে খাটের নিচে ঢুকে পড়ি।
এই ছাদের সাথে আমার শৈশবের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পরে আর একদিন শেয়ার করবো।