পশ্চিমা: শুধুই কি একটি শব্দ নাকি একটি বিশ্বাস?!

in BDCommunity3 years ago

আজকে অনেক দিন পর আমার এক বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই বন্ধুর সাথে আমার বেশিরভাগ সময়ই খুব গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হয়ে থাকে। আজকে অনেক দিন পর বাসায় এসেছি শুনেই দেখা করতে চলে আসলো। অনেক দিন পর দেখা!! অনেক দিন বলতে আসলেই অনেক দিন। সৌরভ আমার খুবই কাছের বন্ধু। একটা সময় ছিল যখন ক্যাম্পাস থেকে এসে টিউশন শেষ করেই আড্ডায় বসে যেতাম। দুজনের ক্যাম্পাস ভিন্ন হলেও, দিন শেষে সেই বেকারের পেছনের টংয়ের দোকানটায় বসা হতোই আমাদের।

ও আসার পর আমরা এলাকার চায়ের দোকানে চলে যাই। সেখানে বসে চা এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো ওর মনটা ভালো নেই। রাখ ঢাক না রেখেই জিজ্ঞাসা করি কি হয়েছে। ও বললো যে আজকে ওর এক বন্ধুর সাথে আস্তিকতা ও নাস্তিকতা নিয়ে কথা হয়েছিলো। বলে রাখা ভালো আমিও ওর ওই বন্ধুকে চিনি। সে কোন সুপ্রিম পাওয়ার অথবা ঈশ্বরে বিশ্বাসী না। এক কথায় সে নিজেকে নাস্তিক বলে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে। তার বিশ্বাসকে আমরা সবসময় সম্মান করি। তাই, সে যেন কখনো অস্বস্তিতে না ভোগে তাই আমরা কখনো আমাদের আড্ডায় তাকে এসব নিয়ে প্রশ্ন করি না।

তো সৌরভ বললো, তার ওই বন্ধুটি এসেই আজকে আস্তিকতা ও নাস্তিকতার মধ্যে কোন বিশ্বাসটা বেশি গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে আলোচনা করতে চাইলো। অনিচ্ছা সত্যেও বন্ধুর পিড়াপীড়িতে সেও আলোচনায় আল্লাহর উপর বিশ্বাস কেন জরুরী তা নিয়ে আলোচনা করা শুরু করলো। তবে সবচেয়ে যেটা হলো তার জন্যই আসলে সৌরভের আজকে মন খারাপ। তার ওই বন্ধু আলোচনার এক পর্যায়ে নাকি তাকে পার্সোনাল এটাক করা শুরু করে তার বিশ্বাস নিয়ে। ব্যাপারটা আমাকেও একটু নাড়া দেয়। তাই সৌরভের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করি। এখানে যদিও আমাদের বিশ্বাস একই তাই হয়তো অনেকেই ভাবতে পারে আমাদের আলোচনাটা পক্ষপাতমূলক ছিল। তবে আসলে ব্যাপারটা এমন হয় নি। সৌরভের সে বন্ধুও পরবর্তীতে আলোচনায় যোগ দেয়। এবং তার বিকেলে করা আচরণের জন্য সৌরভের কাছে ক্ষমা চায়। এবং তারপর আমরা প্রায় আধা ঘন্টা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। তবে ওই বন্ধুর সাথে আলোচনা করে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জাগে। আসলে প্রকৃত নাস্তিকতা নাকি মেকি পশ্চিমা সাংস্কৃতিক মনা এই দুইটা বিষয় আমাদের মধ্যে পরিষ্কার না এখনো। আবার যারা নিজেদেরকে নাস্তিক বলতে চাইছেন তারাই বা কেন জানি না পশ্চিমা বিশ্বাসকে নিজেদের মধ্যে প্রতিফলিত করতে যেয়ে কেমন একটা কিম্ভূতকিমাকার পরিস্থিতিতে পরে যাচ্ছে। তাই এইগুলো নিয়েই ভাবছি আজকের লিখাটা লিখবো।

আপনি ঈশ্বরের ধারণাকে প্রশ্ন করবেন, বিভিন্ন ধর্মকে প্রশ্ন করবেন, চাইবেন সে সব নিয়ে আলোচনা হোক, কিন্তু আপনার যে পশ্চিমমুখী ধারণা, চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস, সেটাকে প্রশ্ন করলেই গালিগালাজ করবেন, গালিগালাজ না করলেও অন্তত বানিয়ে দেবেন ‘ব্যাকডেটেড’, তা তো হবে না! আপনি বলবেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা, আবার অপরদিকে কেউ আপনার বিশ্বাসকে প্রশ্ন করলে ব্যবহার করবেন চ বর্গীয় শব্দবন্ধ, তা কীভাবে হয়? ধর্মান্ধতার বিষয়ে নিয়ে খুব সভা-সেমিনারে যাবেন, অথচ আপনি যে চোখ বন্ধ করে পশ্চিমকে বিশ্বাস করছেন, যাচাই করবার মনোভাব পোষণ করছেন না, এ বিষয়ে কেউ কথা বললেই হয়ে যাবে ‘বিকৃতমনা’?

সারাবিশ্বেই বহুজাতিক করপোরেশনগুলো আইওয়াশ করছে। আপনাকে ব্যক্তি স্বাধীনতা, মুক্তবাজার অর্থনীতি, নব্য-উদারতাবাদ, ব্যক্তিকেন্দ্রীকতা ইত্যাদির কথা বলে আসলে তাদের কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস চাপিয়ে দিচ্ছে। বলছে আগে আমরা অসভ্য, বর্বর ছিলাম, এখন আরও সভ্য, বর্বর হওয়ার উপায় হলো নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বাসকে গ্রহণ করা। এই বিশ্বাসকে গ্রহণ করলে আপনি আধুনিক হতে পারবেন, যদিও এই বিশ্বাসগুলোকে প্রশ্ন করার উপায় তারা রাখেনি।

অস্বীকার করব না পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞান গত কয়েক শতকে বেশ উন্নতি লাভ করেছে। এই উন্নতির কথা বলতে অনেকই বস্তুগত যেসব উন্নয়ন সেসবের কথা বলেন : মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন, ফ্রিজ, এসি। কিন্তু এই বস্তুগত উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে বলে তাদের বিশ্বাস, জ্ঞান, দর্শন, নৈতিকতা—এসবকে প্রশ্ন করার অধিকার কি আমরা হারিয়েছি? অনেকে বলবেন, আপনিই তো কম্পিউটার ব্যবহার করে এই লেখাটা লিখছেন, এসব কি পেতেন পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডের বিকাশ না ঘটলে?
অস্বীকার করব না পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডের বিকাশের ফলে আমরা এসব পেয়েছি। কিন্তু মাইক্রোসফটের তৈরি উইন্ডোজ ব্যবহার করছি বলে কি আমি মাইক্রোসফট ও তার দর্শনকে প্রশ্ন করতে পারব না? যাদের তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার করেছি তারা কি আজ আমার ঈশ্বর? খুব তো মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেন; কিন্তু আপনারাই তো পাশাপাশি বলছেন, তুমি যখন পশ্চিমা যন্ত্রপাতি ব্যবহার বাদ দিতে পারছ না, তখন এসব নিয়ে কথা বলো কেন? এই সিস্টেমের মধ্যেই থাকো না বাপ!

আপনাকে-আমাকে বলা হচ্ছে : ব্যক্তি তুমি স্বাধীন হয়ে গেছ। কিন্তু না। আসল কথা হলো আমরা হচ্ছি করপোরেশনের বানানো পাপেট। করপোরেশনকে প্রশ্ন করলেই আমাদের ‘ব্যাকডেটেড’ আখ্যা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ব্যক্তিকে পণ্যে রূপান্তরের বিষয়ে কথা বলতে দেওয়া হবে না আপনাকে, পেছনে যুক্তি দেওয়া হবে, আপনি তো পণ্যে রূপান্তরের প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল, তাহলে প্রশ্ন করেন কেন? কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সমাজে থেকে একটি ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল হলে কি ব্যক্তি সেই ব্যবস্থা বা সমাজের বিভিন্ন বিষয়কে প্রশ্ন করতে পারবে না?

আসুন ভাবি। পশ্চিমকে প্রশ্ন করলেই আপনাকে কিছু মানুষ প্রান্তিক বা Marginalized করে দেবে, বলবে আপনি মধ্যযুগের প্রতিনিধিত্ব করে সমাজকে হাজার বছর পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন! কিন্তু তাতে কী? প্রশ্ন করা চাই। প্রশ্ন না করলে তো অধিকতর উন্নত ব্যবস্থা আমরা পাব না! আর আপনি যাচাই করে দেখতে পারেন, আপনার মতো বহু মানুষ পশ্চিমকে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন করেছে; Marginalized হওয়ার ভয়ে চিন্তাভাবনা প্রকাশ থেকে বিরত থাকা কাজের কথা নয়!

এই অন্ধ পশ্চিমপ্রেমীদের মতের বিরুদ্ধে কথা বললে তারা গৎবাঁধা কিছু বুলি ব্যবহার করবে : আপনার মগজে গোবর, আপনি সমাজকে ‘প্রগতির’ পথ থেকে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ইত্যাদি!

যদি তুমি পশ্চিমকে তোয়াজ করো তবেই তুমি বেশ,
যদি প্রশ্ন তোলো পশ্চিমকে তবেই ব্যাটা তুই শেষ!

কিন্তু এসবকে খুব বেশি পরোয়া করলে কি সত্যিই দরকার আছে? এসবকে পরোয়া করলে কি সত্যিই কল্যাণের দিকে যাবে পৃথিবী?
প্রশ্ন করুন নিজেকে!

image.png

Source

Sort:  

Congratulations @abmamun! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s):

You have been a buzzy bee and published a post every day of the week.

You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word STOP

Check out the last post from @hivebuzz:

Hive Power Up Month - Feedback from February day 17
Support the HiveBuzz project. Vote for our proposal!

Doesn't matter to me whether it's a word or belief, but I desire to be there, in Texas, in the wilderness where gun slingers reign. 😂

Effects of watching movies of Western genre too much 🔫🔫

You post has been manually curated by BDVoter Team! To know more about us join our Discord.


Delegate HIVE POWER to us & earn HIVE daily.

FOLLOW OUR HIVE AUTO CURATION TRAIL