মাত্র দেড় বছর আগে বিদেশে এসছে লায়লা,ঢাকাতে স্বামী ছাড়া ছিলো মোট তের বছর, তিরিশি বছরের সংসারজীবনের প্রথম ১৫ বছরের মাথায় দুই ছেলেকে রেখে বাদশা চলে আসে আমেরিকায়,তখন রিংকু,টিংকুর বয়স ১৫ এবং ১১ ।ব্যস, লায়লা এর পর থেকে একাই পার করেছে ১৩ বছর,ঠিক একা না কারন মায়ের সংসারে লায়লা বড়বোন,বড়মেয়ে —– আচ্ছা এই অবেলায় এসব কথা আসছে কেন মাথায় ?
লায়লা চোখ বন্ধ করে,ঘুমের ভান করে,পাশের টেবিলে বসে আছে লায়লার ইরানী বান্ধবী তাহিরা,বয়স প্রায় ওর সমান,তবে লায়লার মতো তাহিরার বড় বড় ছেলে নেই ।
আবার চোখ বন্ধ হয়ে আসে,টিংকু গেছে ইয়র্ক এ ক্লাস করতে,রিংকু একটা সিকিউরিটির কাজ করে,সামারে দিন বড়। ওরা ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা,ঘরে রান্না নেই,সকালে বাড়ি থেকে বের হবার আগে মাছ/মাংশ বের করেছিলো রান্না করবে বলে,কিন্ত সংসারের উপর ঘৃনা ধরে গেছে ওর,হ্যাঁ শব্দটা ঘৃনাই হবে, মনে মনে বার কয়েক উচ্চারন করে, এমন সময় তাহিরার গলা—-
লায়লা,তুমি এই দেশে আছো,তোমার সব সাপোর্ট আছে,কিচ্ছু ভেবো না, প্রথম প্রথম তাই হয়তো এডজাষ্ট করতে সময় লাগছে—
জানো,ভাবছিলাম তোমার বাদশা ভাই এর কথা,মানুষটা আমার জন্য অনেক করেছে,যখন দেশে ছিলাম,কথায় কথায় টাকা পাঠানো,ছেলেদের নিয়ে আমি রাজার হালে চলতাম,কে যোগাতো খরচ? সেই তো তোমার বাদশা ভাই,তাই না?
কথাগুলো বলে হালকা বোধ করে লায়লা,সত্যিকার অর্থে এই সবগুলো উচ্চারনই সত্য , ভীষন সত্য। কিন্ত মাত্র দেড় বছরেই লায়লার বিদেশে আসার ঘোর কেটে গেলো,অপেক্ষা তো ছিলো দীর্ঘ তের বছরের, হ্যাঁ এতগুলো বছর লায়লা তীর্থের কাকের মতো বসে ছিলো, কানাডায় আসবে বলে, বাদশা আমেরিকাতে কাগজের সুবিধা করতে পারেনি বলে কানাডায় এসছিলো বছর ৭ আগে,এরপর লায়লা এবং ছেলেদের আনতে সময় লেগেছে আরো তিন বছর,এখন টিংকু পরিনত যুবক,আগামী মাসে ওর ৩০ বছর হবে,আর রিংকুর ২৩ বছর,মাঝে তেরটা বছর পার করেছে লায়লা, একদিন বিদেশে নিজের সংসার হবে, নিজের মতো করে স্বামী নিয়ে থাকবে — এতদিন পরে,এই কি তার কানাডার জীবন? এত উপেক্ষিত জীবনযাপন করবার জন্যই কি এত আয়োজন ? বাদশা সোশালে( সরকারী ভাতা) থাকে,কিছু মেডিসিন সাপোর্টও পায়, সেই কারনেই কি বাদশা এমন অর্থব জীবনযাপন করে? লায়লার কোন হিসেব মিলতে চায় না,কিছুতেই না,কিšু— কাকে বলবে এসব কথা,কোথায় দাড়াবে ও—–
কি হলো তুমি কি এতো ভাবো ? তাহিরা গরম কফি নিয়ে দাড়িয়ে,সাথে নাস্তা ।
তুমি একা একা বেশ থাক্াে,এই ভালো,লায়লা হেসে কফির কাপ হাতে নেয়,এখন বিকেল চারটা,ইএসএল (ইংলিশ ফর সেকেন্ড ল্যংগুয়েজ) ক্লাস থেকে ও যখন এসছে তখন সকাল সাড়ে দশটা,লায়লা কি দুর্বিসহ রাত কাটিয়েছে গতকাল তার কোন আঁচ পাইনি তাহিরা পাবার কথাও নয়,এটা বিদেশ বিঁভুই,কার কাছে যাওয়া যায়,কি করা,কোন কিনারা জানা নেই লায়লার
হেই লায়লা, বাদশা ভাই কি তোমাকে নিতে আসবেন,যা ভালো মানুষ উনি,তাহিরা বরাবরই বাদশার প্রশংসায় ভরপুর,আর কি অঘোম নিয়তি লায়লার, আবার ডুবে যায় গতরাতের আতংকে —– কি উদ্ধত আচরন বাদশার, হ্যাঁআ, তোমার জন্য কি আমি চোর হয়ে ঘরে বসে থাকবো নাকি ? অনেক করেছি এক বছর তোমাদের জন্য,আর না,এবার আমার মতো আমাকে থাকতে দাও,বলেই বিকেল ছয়টায় বেড়িয়ে যাবে বাদশা, আর ফিরবে পরের দিন সকাল দশটায়,লায়লাকে ক্লাসে দিয়ে সারাদিন পরে পরে ঘুমাবে– গত দুমাস হলো চলছে এই রুটিন,কোন কিছু শুনবে না,বাইরে রাত কাটাতেই হবে,জুয়া খেলতেই হবে —- কি ভীষন অনাচার — মাঝে টিংকু একদিন বলছিলো,মা এই বাবার কানাডার জীবন? এইসব মানুষদের সাথে বাবা চলেন? ছিঃ আমি আমার বন্ধুদের কাছে বাবার নাম বলিনা, জানো তুমি, এই তোমার বিদেশ? সেদিন লায়লার মুখে কথা সরেনি,তের বছর ধরে যে জীবনটার স্বপ্ন দেখেছে লায়লা, ছেলেদেরকে বলেছে আমরা একদিন বিদেশে যাবো,তোমরা কানাডিয়ান নাগরিক হবে ——-
কি হলো তোমার ? কফি খেলে না,কি হয়েছে, চলো চলো বাদশা ভাই দাড়িয়ে আছেন নীচে আমরা আজকে বীচের পাড়ে যাবো — চটপট করো,তাহিরা তাড়া করছে,বিকেলের আলো মোহনীয় হয়ে উঠছে চারিদিকে।
লবিতে নামতেই বাদশা এগিয়ে আসে,সারাদিন পরে পরে ঘুমিয়েছে — রাতের মদ ও জুয়ার নেশা জেগে উঠবে কিছুক্ষনের ভিতর , লায়লা গাড়িতে উঠতেই বাদশা হাসিমুখে বলে, চলো চলো দেরী হচ্ছে — তোমাদের বীচে নামিয়ে দিয়েই আমাকে একটা কাজে যেতে হবে ,তাহিরা কাইন্ডলি তুমি লায়লাকে একটু ড্রপ করো বাড়িতে — আমি তোমাদের গরম কফি খাওয়াবো কেমন,বাদশা সেই হিংস্র দৃষ্টি দিয়ে একবার তাকায় লায়লার চোখে,মুর্হুতেই গাড়ি স্টার্ট করে সশব্দে।